পর্যটক টানতে ৭০টির বেশি দেশের জন্য ভিসামুক্ত সুবিধা দিচ্ছে চীন

ভিসানীতিতে বড় ধরনের শিথিলতা আনার পর ধীরে ধীরে আবার বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে চীনে। বর্তমানে ৭৪টি দেশের নাগরিকরা কোনো ভিসা ছাড়াই ৩০ দিন পর্যন্ত অবস্থান করতে পারছেন দেশটিতে।
চীনের সরকার পর্যটন ও অর্থনীতিকে চাঙা করতে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে ধারাবাহিকভাবে এই ভিসামুক্ত নীতির পরিধি বাড়িয়ে চলেছে। ২০২৪ সালে ২ কোটির বেশি বিদেশি পর্যটক ভিসা ছাড়াই চীন সফর করেছেন—জাতীয় অভিবাসন প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ এবং মোট পর্যটকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
৭৪টি দেশের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার
চীনে এখন ৭০টির বেশি দেশের নাগরিকরা এক মাস পর্যন্ত ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারেন। অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জর্জিয়ার নাগরিক জর্জি শাভাদজে বেইজিংয়ের টেম্পল অব হেভেনে ঘুরতে এসে বলেন, 'ভিসার জন্য আবেদন করা, দূতাবাসে যাওয়া—সব মিলিয়ে এটা খুব ঝামেলার কাজ। এখন এসব ছাড়াই আসা যায়, অনেক সুবিধা।'
যদিও এখনো বেশিরভাগ পর্যটনস্থলে দেশীয় পর্যটকরাই বেশি, তবে পর্যটন সংস্থা ও গাইডরা বলছেন, সামনের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বিদেশি পর্যটকের ঢল নামতে পারে।
২০ বছরের অভিজ্ঞ ইংরেজি ভাষাভাষী গাইড গাও জুন বলেন, 'আমি এখন এতটা ব্যস্ত যে একা আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না।' তাই তিনি নতুন একটি উদ্যোগ শুরু করেছেন—ইংরেজি গাইড হিসেবে কাজ করতে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
২০১৯-এর তুলনায় এখনো কম, তবে আশাবাদী চীন
২০২৩ সালের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর চীন সীমান্ত খুলে দেয়। তবে সেই বছর মাত্র ১ কোটি ৩৮ লাখ বিদেশি পর্যটক দেশটিতে আসেন, যেখানে ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা ছিল ৩ কোটির বেশি।
ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে শুরু করে চীন ধাপে ধাপে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশকেই ভিসামুক্ত সুবিধা দিয়েছে। সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার পাঁচ দেশ, উজবেকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশকেও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৬ জুলাই আজারবাইজান যুক্ত হলে মোট দেশ হবে ৭৫টি।
চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকার কোনো বড় দেশ এখনো এই ভিসামুক্ত তালিকায় নেই।
তবে এই সুবিধাগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এক বছরের পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে চালু করা হয়েছে।

নরওয়ের ভ্রমণকারী অইস্টেইন স্পোরশেইম বলছেন, আগে ভিসার জন্য ওসলোতে চীনা দূতাবাসে দুইবার যাওয়া লাগত, যেটা দুই সন্তানের সঙ্গে অনেক কষ্টকর ছিল। 'এখন এসব আর লাগছে না।'
চীনের বিলাসবহুল ট্যুর পরিচালনাকারী সংস্থা 'ওয়াইল্ডচায়নার' ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেনি ঝাও বলেন, 'নতুন ভিসা নীতি আমাদের জন্য শতভাগ ইতিবাচক।' প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা এখন কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান তিনি।
তাদের মোট ক্লায়েন্টের ৩০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসলেও ইউরোপীয় পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হয়েছে, যেখানে ২০১৯ সালের আগে তা ছিল মাত্র ৫ শতাংশের নিচে।
অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি ট্রিপ ডটকম জানায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে তাদের ওয়েবসাইটে চীনের টিকিট ও হোটেল বুকিং দ্বিগুণ বেড়েছে। এর ৭৫ শতাংশ এসেছে ভিসামুক্ত দেশগুলো থেকে।
ট্রানজিটে ভিন্ন দেশে গেলে ১০ দিনের সুবিধা
ভিসামুক্ত তালিকায় না থাকলেও, কিছু দেশের নাগরিকরা চীন ভ্রমণের বিকল্প সুবিধা পাচ্ছেন। চীনের ন্যাশনাল ইমিগ্রেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্যানুযায়ী, ১০টি দেশের যাত্রীরা ভিন্ন কোনো দেশে ট্রানজিটের সময় চীনে সর্বোচ্চ ১০ দিন পর্যন্ত অবস্থান করতে পারবেন। তবে এর জন্য শর্ত হলো—তাদের যাত্রা শুরু ও শেষ হবে দুটি আলাদা দেশে এবং প্রবেশ করতে হবে নির্ধারিত ৬০টি বন্দর দিয়ে।
এই ১০টি দেশ হলো: চেক প্রজাতন্ত্র, লিথুয়ানিয়া, সুইডেন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউক্রেন, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো।
যদিও এই 'ট্রানজিট ভিজিট' নীতি ৫৫টি দেশের জন্য প্রযোজ্য, তবু অধিকাংশ দেশই ৩০ দিনের ভিসামুক্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ফলে শুধুমাত্র ওই ১০টি দেশকেই এই সীমিত সুযোগ কাজে লাগাতে হচ্ছে।
এই তালিকায় থাকা উন্নত দেশের মধ্যে সুইডেন ও যুক্তরাজ্যই ব্যতিক্রম, যারা ৩০ দিনের সুবিধা পাননি। বিশ্লেষকদের মতে, সুইডেনের লেখক গুই মিনহাইকে ২০২০ সালে চীনে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর থেকে চীন-সুইডেন সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। গুই ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে নিখোঁজ হন এবং পরে চীনের মূল ভূখণ্ডে পুলিশি হেফাজতে পাওয়া যায় তাকে।