প্রথমবারের মতো ব্রিকস সম্মেলনে অনুপস্থিত শি জিনপিং, কিন্তু কেন?

বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির অন্যতম জোট ব্রিকস-এর শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে ব্রাজিলে, তবে এবার গুরুত্বপূর্ণ এই আয়োজন থেকে অনুপস্থিত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির নেতা, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথমবারের মতো ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না শি, অথচ এই জোটকে তিনি বরাবরই বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলের কৌশলের অংশ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন।
সম্মেলনের সময় ও প্রেক্ষাপট
দু'দিনব্যাপী এই সম্মেলন শুরু হয়েছে ব্রাজিলে রিও ডি জেনিরোতে এমন এক সময়, যখন ব্রিকস জোট সম্প্রসারিত হয়ে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ইরান।
এদিকে জোটের কয়েকটি সদস্য দেশকে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত পারস্পরিক শুল্ক আরোপ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এনিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে হবে। এই অবস্থায়, ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি বিশ্ববাণিজ্য ও কূটনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্রিকস জোট ঐক্য প্রদর্শনের চাপের মুখেও আছে।
শি'র অনুপস্থিতি কী বার্তা দেয়?
বিশ্লেষকদের মতে, শি জিনপিং নিজে না গেলেও চীন ব্রিকসকে কোনোভাবেই কম গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং এই জোটের মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তির মোকাবিলার চেষ্টাই বেইজিংয়ের অন্যতম লক্ষ্য।
"ব্রিকস হলো বেইজিংয়ের কৌশলের অংশ, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়ার আশঙ্কা কমানো যায়," বলেন সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক চং জা ইয়ান।
তবে ট্রাম্পের সময় মিত্রদের সঙ্গেও যখন যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, তখন শি'র জন্য ব্রিকস হয়তো শীর্ষ অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। বরং তিনি এখন মনোযোগ দিচ্ছেন দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার দিকে।
আর কে অনুপস্থিত?
শি জিনপিং ছাড়াও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্মেলনে সরাসরি উপস্থিত থাকছেন না। তিনি ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন, কারণ ব্রাজিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য হওয়ায়– পুতিন সেখানে গেলে ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করতে আইনিভাবে বাধ্য হতো দেশটি।
শি ও পুতিনের অনুপস্থিতিতে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রীয় সফরের পাশাপাশি ব্রিকস সম্মেলনেও যোগ দিচ্ছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাও থাকছেন সম্মেলনে।
নতুন সদস্যদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোয়ো সুবিয়ানতো'র অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত। তবে সৌদি আরব এখনও পুরোপুরি সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে কি না, তা নিশ্চিত নয়।
শি'র সিদ্ধান্তের কারণ
বিশ্লেষকদের মতে, শি সম্প্রতি ব্রাজিলে জি২০ সম্মেলন ও রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন, ফলে এবার না যাওয়াটা ব্রাজিলের প্রতি অবজ্ঞা নয়। তাছাড়া বড় কোনো অগ্রগতির প্রত্যাশা না থাকাও সম্ভবত শি'র নিজে না যাওয়ার পেছনের কারণ।
চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় চীনের সর্বোচ্চ এই নেতা মূলত সে দিকেই এখন নজর দিচ্ছেন। এছাড়া চীনের আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্মেলনের প্রস্তুতিও চলছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে, শি জিনপিংয়ের বদলে অংশ নিচ্ছেন দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা, প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং। তিনি সেখানে জোটের বৃহৎ জ্বালানি তেল-রপ্তানিকারক সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিংয়ের জ্বালানি সহযোগিতা জোরদার করা নিয়ে নিয়ে আলোচনা করবেন। এর পাশাপাশি ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে লেনদেন ও বাণিজ্যে চীনের ডিজিটাল ও অফশোর মুদ্রার ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়টিও এগিয়ে নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডি-ডলারাইজেশন: ডলারমুক্ত বাণিজ্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
ব্রিকস গঠিত হয় ২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন নিয়ে। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্ত হয়। শুরু থেকেই জোটটি নিজেকে উন্নত দেশগুলোর জোট জি৭-এর বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
বিশ্বে "মাল্টি-পোলার" অর্থাৎ বহু কেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তোলার আলোচনায় ব্রিকসের ভূমিকা বাড়ছে। বিশেষত, চীন ও রাশিয়া নিজেদের আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে এ প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছে।
তবে সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈচিত্র্য, এবং পারস্পরিক বিরোধের কারণে জোটের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। গত মাসে ইরানে হামলার ঘটনায় জোটের বিবৃতিতে শুধু 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করা হয়, এমনকী সেখানে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের নামও উল্লেখ করা হয়নি।
তবে মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানো বা ডি-ডলারাইজেশন হলো এমন একটি বিষয়, যেখানে ব্রিকস এর সব সদস্যই মোটামুটিভাবে ঐক্য দেখাতে পারে। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইরান, যারা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে রয়েছে, তাদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রাজিলও স্বাগতিক দেশের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি ও তার উন্নয়নের কথা বলেছে। রাশিয়াও গত বছর এমন একটি পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছিল।
তবে ব্রিকস এর নিজস্ব মুদ্রা চালুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। গত বছর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা এমন প্রস্তাব দিলেও, অন্য সদস্যরা তাতে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক নজর
ট্রাম্প ইতোমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ব্রিকস কোনো বিকল্প মুদ্রা চালু করলে তিনি 'শত্রু দেশ' হিসেবে দেখবেন এবং জোটভুক্ত দেশগুলোর ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন।
রিও সম্মেলনে তাই দেশগুলো কতটা জোরালোভাবে পারস্পরিক বাণিজ্যে নিজ নিজ জাতীয় মুদ্রা ব্যবহারের পক্ষে কথা বলে, তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরে থাকবে। চীন যদিও শীর্ষ সদস্য, তবু বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের প্রভাব এখনও প্রবল—এটাও সত্য।