১৯৪০-এর এই হারানো চীনা টাইপরাইটার যেভাবে আধুনিক কম্পিউটিং বদলে দিয়েছে

পুরনো এক টাইপরাইটার ঘিরে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান ও চীনের পণ্ডিতদের মধ্যে। বহু বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া এই যন্ত্রটি শুধু আধুনিক চীনা কম্পিউটিংয়ের উৎপত্তির গল্পের অংশ নয়, বরং ভাষার রাজনীতি নিয়েও চলমান বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
চীনের আধুনিক কম্পিউটিংয়ে প্রবেশ দেশটিকে আজকের প্রযুক্তিনির্ভর পরাশক্তিতে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তারও আগে বিংশ শতাব্দীর কিছু প্রাজ্ঞ চীনা মনীষীকে—কীভাবে জটিল চিত্রলিপিতে গঠিত চীনা লিখন-পদ্ধতিকে টাইপরাইটারে এবং পরবর্তীতে কম্পিউটারে রূপান্তর করা যায়; এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল ।
অন্যান্যদের তুলনায় একজন ব্যক্তি এই প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি হলেন দক্ষিণ চীনের এক খ্যাতনামা ভাষাবিদ ও লেখক লিন ইউতাং। তিনি তার উদ্ভাবিত চীনা টাইপরাইটারের মাত্র একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেছিলেন, যার নাম দেন 'মিংকোয়াই'—ম্যান্ডারিন ভাষায় যার অর্থ 'উজ্জ্বল এবং স্বচ্ছ'।
১৯৪০-এর দশকে তৈরি টাইপরাইটারটির বিস্তারিত পেটেন্ট রেকর্ড ও নকশা যুক্তরাষ্ট্রে এখনো সংরক্ষিত আছে। তবে এর বাস্তব প্রোটোটাইপ বহু বছর ধরে নিখোঁজ ছিল।
পণ্ডিতরা ধারণা করেছিলেন, এটি কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও 'দ্য চাইনিজ টাইরাইটার' বইয়ের লেখক থমাস মুলানি বলেন, 'আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম, এটা আর পাওয়া যাবে না।'
থমাস মুলানি দুই দশক ধরে চীনা কম্পিউটিং নিয়ে গবেষণা করছেন।
গত বছর এক সম্মেলনের সময় মুলানি হঠাৎ একটি বার্তা পান— নিউ ইয়র্কের উত্তরাঞ্চলের এক ব্যক্তি তাদের বেজমেন্টে একটি অদ্ভুত মেশিন খুঁজে পেয়েছেন এবং সেটির ছবি তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
মুলানি স্মৃতিচারণ করেন, 'সেই রাতটা ছিল নির্ঘুম। আমি এলোমেলোভাবে খুঁজছিলাম, মালিক কে হতে পারে।'

অবশেষে যন্ত্রটিরমালিক নিজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জানা যায়, টাইপরাইটারটি তারা এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিনেছিলেন। ওই আত্মীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম খ্যাতনামা টাইপসেটিং মেশিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মার্জেনথালার লিনোটাইপ কোম্পানিতে কাজ করতেন।
প্রতিষ্ঠানটি মিংকোয়াই টাইপরাইটারের একমাত্র পরিচিত প্রোটোটাইপ তৈরিতে সহায়তা করেছিল।
মুলানি পরে নিশ্চিত হন, নিউ ইয়র্কের সেই বেজমেন্টে পাওয়া যন্ত্রটিই লিন ইউতাংয়ের তৈরি মিংকোয়াই টাইপরাইটারের একমাত্র প্রোটোটাইপ।
তিনি বলেন, 'এটা এমন, যেন আপনি ভাবছিলেন কোনো প্রিয়জন আর কখনো ফিরে আসবে না—কিন্তু হঠাৎই তিনি দরজায় এসে হাজির।'
একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
টাইপরাইটারটি কেন তৈরি হয়েছিল—সে গল্প জড়িয়ে আছে চীনা পরিচয় এবং বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সঙ্গে। এর উদ্ভাবক লিন ইউতাং ১৮৯৫ সালে দক্ষিণ চীনে তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু কিং রাজবংশের শেষ পর্যায়ে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় চীনের সংস্কার চেয়ে ছাত্র আন্দোলন ও উগ্র চিন্তাধারার উত্থান ঘটে। । কেউ কেউ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি বাদ দিয়ে পশ্চিমা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন—এমনকি রোমান হরফে চীনা ভাষাকে রূপান্তরের কথাও বলেন অনেকে।
তাইওয়ানে অবস্থিত লিন ইউতাং হাউসের পরিচালক চিয়া-ফ্যাং সাই বলেন, 'সেই দুই বিপরীত ধারার মাঝখানে একটি মধ্যপন্থা তৈরি করেন।'
লিন ইউতাং হাউসে ভাষাবিদ হিসেবে লিনের কাজ সংরক্ষণ করা হয়।
চিয়া-ফ্যাং সাই আরও বলেন, 'তার এই পথটি পূর্ব ও পশ্চিমকে যুক্ত করে। এর লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল যুগেও চীনা ভাষাকে সংরক্ষণ করা।'
চীনা টাইপিং ছিল দারুণ জটিল। কারণ, চীনা ভাষায় কোনো বর্ণমালা নেই—থাকে হাজার হাজার চিত্রলিপি। সেই সময় ম্যান্ডারিন ভাষারও কোনো প্রমিত সংস্করণ ছিল না। মানুষ নানা উপভাষায় কথা বলতেন, যার ফলে শব্দের ধ্বনিগত বানান নির্দিষ্ট ছিল না।
টাইপরাইটার প্রকল্পে লিন পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন মার্কিন লেখিকা পার্ল এস. বাকের কাছ থেকে। তবে খরচ বাড়তে থাকায় তিনি নিজের সঞ্চয়েরও বড় অংশ ব্যয় করেছিলেন।
লিনের নাতনি জিল লাই মিলার বলেন, 'তিনি অনেক টাকা ব্যয় করেছিলেন। প্রচুর।'
তিনি আরও বলেন, 'তবু তিনি কখনো তার সহায়তাকারীদের প্রতি কোনো অভিযোগ পোষণ করতেন না।'

অবশেষে পুনরুদ্ধার
এ বছর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় টাইপরাইটারটি সংগ্রহ করে। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্প্রতি বহু দশকের পুরনো যন্ত্রটিকে পরিষ্কার ও পুনরুদ্ধার করেছে। এটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব এশিয়া লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে এবং শিগগিরই জনসাধারণের জন্য প্রদর্শিত হবে।
জুন মাসের এক সকালে টাইপরাইটারটি কীভাবে কাজ করে তা দেখানোর জন্য অধ্যাপক থমাস মুলানি সাবধানে যন্ত্রটির কাঠের বাক্সটি খুলে দেখান।
এই টাইপরাইটারের বিশেষত্ব ছিল চীনা চিত্রলিপিকে শব্দভিত্তিক নয়, বরং আকার অনুযায়ী ভেঙে দেখার সিদ্ধান্ত। টাইপিস্ট এর্গোনমিক কি-বোর্ডে নির্দিষ্ট আকারের সংমিশ্রণ অনুসন্ধান করে। এরপর কিবোর্ডের ওপরে একটি ছোট পর্দায় [যেটিকে লিন 'ম্যাজিক আই' বা 'জাদুকরী চোখ' বলতেন] আটটি সম্ভাব্য অক্ষর ভেসে ওঠে। এভাবে টাইপরাইটারটি প্রায় ৯০ হাজার অক্ষর পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম।
মিংকোয়াই টাইপরাইটারের ধারণাগুলো আজ আমরা যেভাবে চীনা, জাপানি ও কোরিয়ান ভাষায় টাইপ করি, তার ভিত্তি রচনা করেছে।
মুলানি বলেন, 'এই ব্যক্তিদের অনেকেই [লিনসহ] বোঝাতে চেয়েছিলেন আধুনিকতার মূল্যে নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা বিসর্জন দেওয়ার বিষয়টি তারা মানেন না।'
এই টাইপরাইটারের প্রকৌশল কাঠামোর মধ্যেই লুকানো ছিল এক উচ্চাভিলাষী বৈশ্বিক দর্শন।
টাইপরাইটারের ম্যানুয়াল অনুযায়ী, লিন শব্দের ধ্বনি বা বর্ণমালার পরিবর্তে আকারভিত্তিক ভাষা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁর যন্ত্রকে তাত্ত্বিকভাবে ইংরেজি, রাশিয়ান ও জাপানি ভাষাতেও ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছিল।

মিংকোয়াই টাইপরাইটারের আবিষ্কার নিয়ে সর্বপ্রথম লেখালেখি করা ইয়াংইয়াং চেংবলেন, 'চীনা মানসিকতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে লিন ইউতাংয়ের মতাদর্শ ছিল খুবই চমকপ্রদ। তা হলো— চীনা সংস্কৃতি যেন আত্মকেন্দ্রিক না হয়, এটি যেন উন্মুক্ত ও উদার হয় এবং অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।'
চেং বলেন, এই বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি লিনের নিজের যাযাবর ও বহুভাষিক জীবনের প্রতিফলন।
লিন চীন ও ইউরোপে শিক্ষালাভ করেছিলেন, কিন্তু টানা তিন দশক তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। পরে চীনের মূল ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন প্রতিষ্ঠার পর তিনি তাইওয়ান ও হংকংয়ে চলে যান; হংকং সেসময় ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ।
১৯৪৬ সালে লিন যখন টাইপরাইটারটির জন্য মার্কিন পেটেন্ট আবেদন করেন, ততদিনে তার লিনের কল্পিত বহুসাংস্কৃতিক চীনের স্বপ্ন অনেকটাই ধূসর হয়ে গিয়েছিল। মুক্ত, বহুসাংস্কৃতিক চীনের স্বপ্ন অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে মুলানি টাইপরাইটারটি নিয়ে পূর্ণকালীন গবেষণা করছেন। তিনি যন্ত্রটির অভ্যন্তরীণ কাঠামো বিশ্লেষণ করছেন, এমনকি ভবিষ্যতে এর প্রতিলিপি তৈরির স্বপ্নও দেখছেন।
সম্প্রতি তিনি দেখতে পান, টাইপরাইটারের কালির স্পুলটি এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।
মুলানি বলেন, 'ডেড সি স্ক্রোলের মতো আবিষ্কারে যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, এখানেও ঠিক তেমন কিছু লাগবে।'
তিনি বলেন, এই স্পুলে হয়তো আজও রয়ে গেছে লিন বা তার মেয়ের টাইপ করা শেষ কিছু শব্দ। হয়তো আবিষ্কারকের কিছু কথা আজও রয়ে গেছে তার এই 'জাদুকরী' টাইপরাইটারে।