আকারে গলফ বলের সমান, দুর্গম দ্বীপে বসবাস বিশ্বের ক্ষুদ্রতম ডানাহীন পাখির

উড়তে জানে না এমন পাখিদের জন্য সময়টা ভালো যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ মানুষ। মরিশাসের ডোডো পাখির গল্প প্রায় সবারই জানা—মানুষের হাতে শিকার হয়ে মাত্র কয়েক দশকে এই প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এমন ঘটনা আরও আছে। উত্তর আটলান্টিকের গ্রেট অক, নিউজিল্যান্ডের মোয়া, মাদাগাস্কারের এলিফ্যান্ট বার্ড ও ভারত মহাসাগরের রিউনিয়ন দ্বীপের রিউনিয়ন আইবিস—সবকটি পাখিই মানুষ সেখানে পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
২০২০ সালে 'সায়েন্স অ্যাডভান্স' সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, উড়তে না পারা পাখিদের অবস্থা কতটা খারাপ। গবেষকরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে মোট ৫৮১টি পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৬টি উড়তে পারত না। অর্থাৎ, বিলুপ্ত পাখিদের ২৯ শতাংশই ছিল এ ধরনের। অথচ বর্তমান জীবজগতে উড়তে পারা ও না–পারা পাখির অনুপাত প্রায় ১০০:১। সেই হিসেবে এদের বিলুপ্তির হার অনেক বেশি।
তবে সব ডানাহীন পাখি যে হারিয়ে গেছে, তা নয়। এখনো উটপাখি, ইমু, পেঙ্গুইন, উইকা ও আরও কিছু প্রজাতির সংখ্যা ভালোই আছে।
বর্তমানে উড়তে না পারা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট আকৃতির পাখি হলো 'ইনঅ্যাক্সেসিবল আইল্যান্ড রেইল'। আকারে ছোট হলেও এ পাখির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। যদিও এটি পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট ও সীমিত অঞ্চলে মাত্র বাস করে।

পাখিটির ওজন এক পাউন্ডের দশভাগের একভাগের থেকেও কম (প্রায় একটি গলফ বলের সমান) এবং দৈর্ঘ্য মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি। এই ক্ষুদে আকৃতির জন্যই ইনঅ্যাক্সেসিবল আইল্যান্ড রেইল (বৈজ্ঞানিক নাম Laterallus rogersi) পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট উড়তে না-পারা পাখি হিসেবে পরিচিত।
এই পাখিটি কেবল দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত ইনঅ্যাক্সেসিবল আইল্যান্ডেই বাস করে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে জন্ম নেওয়া এ দ্বীপটি ট্রিস্টান দা কুনহা দ্বীপপুঞ্জের অংশ—যা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম দ্বীপ অঞ্চলগুলোর একটি।
ইনঅ্যাক্সেসিবল আইল্যান্ড নিজের নামের মতোই দুর্গম। চারদিকে উঁচু খাড়া পাহাড় আর সাগরের ভয়ংকর ঢেউ যেন দ্বীপে মানুষের প্রবেশ ঠেকাতে এক প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে দ্বীপের বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে 'রেইল' নামের পাখিটি, শিকারি প্রাণী ও মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজস্বভাবে বিবর্তিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
মাত্র সাড়ে পাঁচ বর্গমাইল আয়তনের হলেও দ্বীপটি আশ্চর্যজনকভাবে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এর খাড়া পাহাড়ি জমি, ঘাসে ঢাকা প্রান্তর ও ঘন উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত পরিবেশ এ বৈচিত্র্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে।
ইনঅ্যাক্সেসিবল আইল্যান্ড রেইল নামের পাখিটি সাধারণত ঘন তৃণমূল ও ফার্নের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে সে পোকামাকড়, বীজ ও ছোট ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণী খুঁজে বেড়ায়। উড়তে না পারলেও এই পাখি দ্রুতগতির ও চতুর দৌড়বিদ—যা তাকে সামুদ্রিক পাখিদের মতো শিকারিদের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করে।

পাখিটির পূর্বপুরুষ উড়তে পারত বলে ধারণা করা হয়, যারা কোনো এক ঝড়ে পথভ্রষ্ট হয়ে দ্বীপটিতে পৌঁছায়। সেখানে শিকারির অনুপস্থিতি ও উড়ে বেড়ানোর প্রয়োজন না থাকায়, ধীরে ধীরে তারা উড়তে পারা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাখিগুলোর আকার ছোট হতে থাকে এবং তারা এখনকার ক্ষুদ্রাকৃতির, ডানাহীন অবয়বে রূপান্তরিত হয়।
সীমিত বিস্তার ও বিশেষ বাসস্থান থাকা সত্ত্বেও, ইনঅ্যাক্সেসিবল আইল্যান্ড রেইল বর্তমানে আইইউসিএনের তালিকায় 'সংবেদনশীল' হিসেবে চিহ্নিত। তবে এর সংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থিতিশীল। এর বড় একটি কারণ হলো দ্বীপটি নির্জন, কঠোর সংরক্ষণ নীতি চালু আছে এবং ইঁদুর বা বিড়ালের মতো বহিরাগত প্রাণীর অনুপস্থিতি—যারা অন্যান্য দ্বীপে পাখির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।
তবুও বিজ্ঞানীরা সতর্ক রয়েছেন। কারণ এই প্রজাতির সমস্ত পাখিই একমাত্র এই দ্বীপে সীমাবদ্ধ, যাদের সংখ্যা আনুমানিক ৫ থেকে ১০ হাজার। যদি জলবায়ু পরিবর্তন বা কোনো বহিরাগত শিকারির হুমকি দেখা দেয়, তাহলে হঠাৎ করেই এই প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে।
বিশ্বের অন্যান্য ছোট ডানাহীন পাখি
গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে দেখা পাওয়া যায় এমন 'ফ্লাইটলেস করমোরান্ট' বা 'ডানাহীন করমোরান্ট' (Phalacrocorax harrisi)-এর। মোটা শরীর ও খাটো ডানার এই পাখি উড়তে না পারলেও দুর্দান্ত সাঁতার কাটে। আকাশে ওড়ার পরিবর্তে পানির নিচে ডানাগুলোকে রাডারের মতো ব্যবহার করে এরা। ফারনান্দিনা ও ইসাবেলা দ্বীপের পাথুরে উপকূলে মাছ ও ইল ধরেই এদের জীবন কাটে। বর্তমানে এই পাখির সংখ্যা আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ এবং এটি 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে তালিকাভুক্ত। তবে ধারাবাহিক সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় পাখিগুলোর সংখ্যা এখন স্থিতিশীল।

অন্যদিকে, তাসমানিয়ার 'নেটিভ হেন' বা স্থানীয় মুরগি (Tribonyx mortierii) উড়তে না পারলেও ছোট আকৃতির এই পাখিটি ঘণ্টায় ৩১ মাইল পর্যন্ত গতি তুলতে সক্ষম। তাসমানিয়ার খোলা ঘাসের মাঠ ও জলাধারের ধারে দলবদ্ধভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় তাদের। দ্বীপের অন্যান্য উড়তে না পারা পাখির মতো হুমকির মুখে নয় 'নেটিভ হেন', বরং তাসমানিয়ায় শিকারির সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় এরা নিরাপদেই রয়েছে।

নিউজিল্যান্ডও ছোট ডানাহীন পাখিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। সেখানকার 'ওয়েকা' (Gallirallus australis) নামের পাখিটি মুরগির আকারের। কৌতূহলী, চতুর এই রেইল প্রজাতির পাখিকে প্রায়ই ক্যাম্পের আশপাশে খাবারের খোঁজে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। অভিযোজন ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার জোরেই অনেক অঞ্চলে এগুলোর সংখ্যা বেশ ভালো। তবে আবাসস্থল হারানো ও শিকারির আক্রমণে কিছু এলাকায় এগুলোর সংখ্যা কমে গেছে। সে কারণে এদের সংরক্ষণেও নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ।
