বয়স বাড়লে পিঠ কুঁজো হয় কেন, এই ঝুঁকি কীভাবে কমানো যায়?

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। অনেকের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডে বাঁক, কাঁধ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং মাথা নিচু হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অনেকেই এটিকে 'হাঞ্চব্যাক' বা 'রাউন্ডব্যাক' নামে চেনেন, তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর নাম কাইফোসিস। যখন এই বাঁক স্বাভাবিক মাত্রার (৪০ ডিগ্রি) চেয়ে বেশি হয়ে যায় এবং সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয়না তখন একে বলা হয় হাইপারকাইফোসিস। এ অবস্থায় ব্যথা, নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা এবং জীবনমানের অবনতি দেখা দিতে পারে।
এটি কীভাবে হয়, আর ঝুঁকি কমানোর উপায় কী?
স্বাভাবিকভাবে মেরুদণ্ড 'এস'-আকৃতির হয় এবং উপরের দিকে সামান্য বাঁক থাকে। কিন্তু যখন এই বাঁক অতিরিক্ত হয় এবং তা স্থায়ীভাবে রয়ে যায়, তখনই সমস্যার শুরু। একটি সাধারণ কারণ হলো দীর্ঘ সময় খারাপ ভঙ্গিতে বসে থাকা বা কাজ করা। যাদের মধ্যে দিনের পর দিন ডেস্কে ঝুঁকে কাজ করার প্রবণতা থাকে, বা মোবাইল স্ক্রিনে মাথা নিচু করে থাকেন, তাদের মধ্যে এই 'পোস্টারাল কাইফোসিস' দেখা দেয়। এটি সাধারণত ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, তবে সঠিক ব্যায়াম, স্ট্রেচিং ও দেহভঙ্গি সচেতনতার মাধ্যমে তা অনেকাংশেই সংশোধনযোগ্য।
পিঠ বাঁকা হওয়ার কারণ কী?
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যাদের হাড় ক্ষয়ে যেতে থাকে, তাদের মধ্যে দেখা যায় এজ-রিলেটেড কাইফোসিস বা হাইপারকাইফোসিস। মেরুদণ্ডে ক্ষুদ্র ফাটল (ভের্টিব্রাল কমপ্রেশন ফ্র্যাকচার), হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া (অস্টিওপোরোসিস) প্রভৃতি এর মূল কারণ। এসব ক্ষেত্রে এটি কেবল খারাপ বসার ফল নয়, বরং মেরুদণ্ডের গঠনে স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে যায়।
যদি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পরও পিঠ বাঁকা থেকে যায়, যদি পিঠে ব্যথা বা শক্তভাব অনুভব হয়, এবং যদি উচ্চতা আগের চেয়ে তিন-চার সেন্টিমিটার বা তার বেশি কমে যায় তাহলে সেটিকে আর সাধারণ বয়সজনিত পরিবর্তন বলা যায়।
বাঁকা পিঠের অন্যান্য কারণ কী?
কিছু কিশোর-কিশোরীর ক্ষেত্রে হাড় সমানভাবে না বাড়ার কারণে শইয়ারম্যান'স কাইফোসিস (Scheuermann's kyphosis) দেখা দিতে পারে। আবার জন্মগতভাবে কিছু মানুষের মধ্যে কংজেনিটাল কাইফোসিস থাকে, যেখানে শৈশব থেকেই পিঠে স্থায়ীভাবে বাঁক দেখা যায়। অন্যদিকে স্কোলিওসিস হলে মেরুদণ্ড পাশ থেকে দেখতে C বা S আকৃতির হয়ে যায়। লর্ডোসিস এ মেরুদণ্ড নিচের দিকে অস্বাভাবিকভাবে বাঁকিয়ে যায়। এছাড়া আর্থ্রাইটিস, মেরুদণ্ডে আঘাত বা ইনফেকশন থেকেও এই ধরনের বাঁক দেখা দিতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
যদি কারও পিঠ হঠাৎ বাঁকা হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়, নিয়মিত ব্যথা থাকে অথবা উচ্চতা কমে যাওয়ার মতো পরিবর্তন ঘটে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই ফাটল বা গঠনগত সমস্যা থাকে যা ব্যথা না থাকায় নিরীক্ষা না করলে ধরা পড়ে না। অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসাবিদদের মতে, কাইফোসিস, উচ্চতা হ্রাস (৩ সেন্টিমিটার বা তার বেশি), অথবা অজানা পিঠব্যথার ক্ষেত্রে স্পাইন এক্স-রে করানো উচিত।
ঝুঁকি কমাতে কী করা যায়?
তরুণ কিংবা মধ্যবয়সীদের জন্য এখন থেকেই কিছু অভ্যাস গড়ে তোলাই ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরক্ষা। হাড়ের দৃঢ়তা বজায় রাখা, পেশিকে সক্রিয় রাখা এবং সঠিক ভঙ্গি রক্ষা করাই মূল চাবিকাঠি। এজন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, বিশেষ করে পিঠের ওপরের পেশিগুলোর জন্য। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট সক্রিয় থাকার পাশাপাশি খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি রাখা দরকার। ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপান হাড়ের ক্ষয় বাড়ায়, তাই তা পরিহার করাই ভালো।দীর্ঘ সময় ডেস্কে কাজ করলে মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়ানো বা স্ট্রেচ করা উপকারী হতে পারে।
কোন ধরনের ব্যায়াম উপকারী?
যেসব ব্যায়ামে মেরুদণ্ড সোজা হয়, পেশি শক্ত হয় এবং বুক প্রসারিত হয় সেগুলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর। যেমন, ব্যাক এক্সটেনশন (চিৎ হয়ে শুয়ে বুক ধীরে উঠানো), কাঁধের মাঝের পেশির জন্য রেজিস্ট্যান্স ব্যায়াম, সিঁড়ি ভাঙা, হাঁটা, দৌড়, নাচ ইত্যাদি হাড়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বুক ও কোমরের স্ট্রেচিং দেহভঙ্গি উন্নত করে এবং পেশির টান কমায়। যোগব্যায়াম বা পিলাটিস নমনীয়তা, ভারসাম্য ও সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে, তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পেশি শক্ত করার ব্যায়ামই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
তবে অস্টিওপোরোসিস বা মেরুদণ্ডে ফাটল থাকলে ব্যায়ামের ধরন বেছে নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শে। কিছু কিছু আন্দোলন বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে।
বাঁকা পিঠ কি পুরোপুরি ঠিক হওয়া সম্ভব?
যদি সমস্যার মূল কারণ হয় ভঙ্গি ও দুর্বল পেশি, তাহলে সেটি অনেক সময় পুরোপুরি ঠিক করা সম্ভব। তবে হাড়ের গঠন পরিবর্তন হয়ে গেলে পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফেরা কঠিন। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা, ব্যায়াম ও জীবনযাপন পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যথা কমানো, চলাফেরা সহজ করা এবং অবস্থার অবনতি রোধ করাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
অনুবাদ- নাফিসা ইসলাম মেঘা