পুরুষ-নারী কি সত্যিই শুধুই বন্ধু হতে পারে?

"পুরুষ আর নারী কখনো শুধুই বন্ধু হতে পারে না, যৌন আকর্ষণ ঠিকই এসে পড়ে মাঝখানে।" এই বিতর্কিত মন্তব্য ১৯৮৯ সালের রোমান্টিক কমেডি 'হোয়েন হ্যারি মেট স্যালি' চলচ্চিত্রে হ্যারি চরিত্রের মুখে শোনা গেলেও অনেকের কাছে তা এখনো একেবারে বাস্তব।
সম্প্রতি তুরস্কের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ৯০ হাজার মসজিদে ঘোষণা দিয়েছে, "নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব শুরুটা নিরীহ মনে হলেও একসময় তা ব্যভিচারের গহ্বরে ঠেলে দেয়।"
বিজ্ঞানে বিষয়টির কিছু সত্যতাও মেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, নারী-পুরুষ বন্ধুত্বে যৌন টান একেবারেই নেই, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে এক জরিপে দেখা গেছে, নারী-পুরুষের মধ্যকার 'শুধুই বন্ধুত্ব'-এ পুরুষেরাই সাধারণত বেশি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন এবং প্রায়ই ভুলভাবে ধরে নেন, তাদের নারী বন্ধুও একই চিন্তা করছেন।
তবুও এখান থেকেই বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্বের মৃত্যু ঘোষণা করে দেওয়া যায় না। কারণ, বেশিরভাগ মানুষ নিজ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
সম্প্রতি মেটা ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা ১৮০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর বন্ধুত্বের ধরন বিশ্লেষণ করেছেন। তারা তৈরি করেছেন এক অভিনব সূচক। মজার ছলে যার নাম দেওয়া হয়েছে 'হ্যারি মেট স্যালি ইনডেক্স' (ডব্লিউএইচএমএসআই)।
এই সূচকে কারো স্কোর ০ মানে একেবারেই বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু নেই, স্কোর ১ মানে বিপরীত ও একই লিঙ্গের বন্ধুর সংখ্যা সমান, ১ এর বেশি হলে বোঝা যায় বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্ব বেশি।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, ডিজিটাল বন্ধুত্ব মানেই বাস্তব বন্ধুত্ব নয়। ফেসবুকে আমরা অনেককেই বন্ধু করি, যাদের বাস্তবে কখনো দেখিনি। আবার চীন বা ইরানের মতো দেশগুলোতে তো ফেসবুক একেবারেই নিষিদ্ধ!
বিশ্বজুড়ে বন্ধুত্বের বৈচিত্র্য
যেসব সমাজে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা বেশি, যেমন মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকায়, সেখানে বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্ব খুবই কম।
উদাহরণস্বরূপ: লিবিয়া, ইরাক, মিশরের মতো দেশে প্রতি দশটি বন্ধুত্বের মধ্যে মাত্র একটি হয় নারী-পুরুষের মধ্যে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল বা পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্ব অনেক বেশি। সামাজিক মেলামেশা ও যৌন সম্পর্ক নিয়ে যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করে, সেখানেই দেখা যায় বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্বও বেশি গড়ে ওঠে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নারী ও পুরুষ যখন একই হারে কর্মক্ষেত্রে অংশ নেয়, তখন নারী-পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের হার বাড়ে। নাইজেরিয়ার মতো দেশে, যেখানে নারী-পুরুষ প্রায় সমান হারে কাজ করেন, সেখানে হুইমসি স্কোর ০.৬৭ অর্থাৎ নারী পুরুষের বন্ধুত্ব বেশ হয়। অন্যদিকে ভারতে, যেখানে মাত্র ৪৩% নারী কর্মক্ষেত্রে আছেন, সেখানকার স্কোর মাত্র ০.৩৪।
যেসব সমাজে নারীর অধিকার সংকুচিত, যেমন সম্পত্তি কিংবা বিবাহের ক্ষেত্রে- সেখানেও দেখা যায় নারী-পুরুষ বন্ধুত্বের সুযোগ সীমিত।
কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক অ্যালিস ইভান্স বলছেন, "যে সমাজে একজন পুরুষের সম্মান নির্ভর করে নারীর আচরণ বা গোপনীয়তার ওপর, সেখানে নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব প্রায় অসম্ভব।"
তুরস্কের উসাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. নুরে কারামান যোগ করেন, "পরিবারের সম্মান এমনভাবে নারীর আচরণের সঙ্গে জড়িত যে, আত্মীয় নন এমন পুরুষের সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠতা 'অবৈধ' ভাবা হয়।"
আর এই বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নেয় নতুন করে লিঙ্গবৈষম্য।
ড. কারামান বলেন, "পুরুষরা অনেক সময় নারীদের দায়িত্ব নিতে অযোগ্য বা আবেগপ্রবণ ভাবেন, কারণ তারা জীবনে কোনো নারী বস বা সহকর্মীর সঙ্গে কাজই করেননি!"
উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম। কারণ? অনেক নারী এখনো স্বামী বা পিতার অনুমতি ছাড়া বাইরে কাজ করতে পারেন না। যারা করেন, তারাও পিছিয়ে পড়েন অফিসের সেই অঘোষিত 'পুরুষদের চায়ের আড্ডা' থেকে।
উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যেখানে পুরুষ-নারীর বন্ধুত্ব কম, সেখানে সূক্ষ্ম লিঙ্গবৈষম্য বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক নাগরিকই মনে করেন না যে, পুরুষ নারীদের চেয়ে ভালো নেতৃত্ব দিতে পারে।
দক্ষিণ কোরীয় অভিনেতা আন জং গিউন বলেন, "আমি কখনও ভাবি না নারীর সঙ্গে শুধুই বন্ধুত্ব হতে পারে। আমরা তো একেবারেই আলাদা প্রকৃতির। পুরুষেরা ভিডিও গেম খেলে, মদ্যপান করে, নারীরা গল্প করতে ভালোবাসে।"
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেভিড ক্রেচমার একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখেছেন, ছেলেরা যদি মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তাহলে সময়ের সাথে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যায় আরও সমতাভিত্তিক।
তিনি বলেন, "মেয়েরা সমান আচরণ প্রত্যাশা করে, আর ছেলেরা সেটা শিখে, কারণ তারা প্রেম করতে চায়! আর ভালোবাসা পেতে হলে সমান দৃষ্টিভঙ্গি আনতে হয়।"
শিশুরা সাধারণত ছোট থেকে ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে, মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গে খেলতে অভ্যস্ত হয়। এবং পরে জেন্ডার নর্ম ভাঙার চেষ্টা করলে সহপাঠীরা মজা নেয় বা অপমান করে। আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির লরা হ্যানিশ ও ক্যারল লিন মার্টিন পরিচালিত এক প্রি-স্কুল গবেষণায় দেখা গেছে এক প্রোগ্রামে ছেলে-মেয়ে শিশুদের জোড়ায় কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল। কিছু মাস পর দেখা যায়, ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে খেলার আগ্রহ অনেক বেড়েছে।
এটি অন্তঃগোষ্ঠী সংস্পর্শ তত্ত্ব-এর বাস্তব প্রয়োগ। এই তত্ত্ব বলছে "ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে যদি ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাহলে পূর্বধারণা ও বিদ্বেষ কমে যায়।" এটা শুধু ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর জন্যই নয়, লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রেও কাজ করে থাকে।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা