গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যা: স্বামী-স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার ৪

গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ত চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যার ঘটনায় স্বামী-স্ত্রীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি)। শুক্রবার (৮ আগস্ট) মহানগরীর সদর থানার মেট্রো থানাথী ও সালনা এলাকা থেকে পৃথক সময়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারের বিষয়টি রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিশ্চিত করেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—ঘটনার শুরুতে ভিডিওতে যাকে কেন্দ্র করে হামলার সূত্রপাত, সেই নারী গোলাপি; চাপাতি হাতে দৌড়ে আসা (দাড়িওয়ালা ও টুপি পরা) ফয়সাল ওরফে কেটু মিজান; সাদা শার্ট ও জিনস পরা স্বাধীন এবং আল-আমিন। এর মধ্যে গোলাপি ও ফয়সাল স্বামী-স্ত্রী।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। ফুটেজে তাদের হাতে দা, ছুরি ও চাপাতি দেখা গিয়েছিল।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার তাহেরুল হক চৌহান বলেন, হত্যার পর থেকেই একাধিক পুলিশ টিম গুরুত্বের সঙ্গে অভিযান চালিয়ে আসছিল। ফুটেজ বিশ্লেষণ ও অবস্থান শনাক্তের পর তাদের গ্রেপ্তার সম্ভব হয়েছে।
তবে তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত জানাতে চাননি তিনি।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তার একটি মার্কেটের ভেতরে সাংবাদিক তুহিনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। নিহত তুহিন (৩৮) দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ–এর গাজীপুর প্রতিনিধি ছিলেন।

তিনি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে এবং স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওই এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
পুলিশ জানায়, ঘটনার আগে মার্কেটের নিচে এক নারীর সঙ্গে বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তির বাকবিতণ্ডার সময় কয়েকজন সন্ত্রাসী বাদশাকে ধারালো অস্ত্রে আঘাত করে তাড়া করে। তুহিন সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করায় সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে চায়ের দোকান থেকে টেনে বের করে কুপিয়ে হত্যা করে। ফুটেজে দেখা গেছে, হামলাকারীদের হাতে রামদা, বড় ছুরি ও চাপাতি ছিল।
জিএমপির বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন খান জানান, সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় বাসন থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এর একটি মামলার বাদী নিহত তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম এবং অপরটি বাদশা মিয়ার ভাই, যিনি তুহিন হত্যার আগে সংঘটিত আরেকটি হামলার ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। উভয় মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। ঘটনায় সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে তাদের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এদিকে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া সবাই ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। ঘটনার পর রাতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা স্থানীয়ভাবে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রমতে, ভিডিওতে দেখা যাওয়া নারীও ওই ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। ফুটেজে চাপাতি হাতে (দাড়িওয়ালা ও মাথায় ক্যাপ পরা) কোপানোর জন্য দৌড়ানো ব্যক্তির নাম ফয়সাল ওরফে কেটু মিজান, তার বাড়ি চান্দনা চৌরাস্তার চান্না এলাকায়। সঙ্গে থাকা অন্যদের মধ্যে শাহজামাল, বুলেট ও সুজনের নাম জানা গেছে। আরও কয়েকজনকে চেনা গেলেও তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এদের সবার বিরুদ্ধেই একাধিক ছিনতাই মামলা রয়েছে।
ফুটেজে ঘটনার শুরুতে প্রথমে যে নারীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছিল, তিনি বাদশা মিয়া। ঘটনার পর তিনি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয় এবং বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাদশা মিয়া অভিযোগ করেন, ওই নারী ও হামলাকারীরা একই দলের সদস্য এবং তারা তার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। তিনি আগে তাদের চিনতেন না।
শুক্রবার সকালে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সহকর্মী, স্বজন ও সাধারণ মানুষ এতে অংশ নেন।

প্রতিদিনের কাগজ–এর সম্পাদক খাইরুল আলম রফিক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমরা সাগর-রুনী হত্যার বিচার পাইনি, তুহিন হত্যার বিচার কবে পাব, জানি না।'
ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতেই এলাকায় বিক্ষোভ হয় এবং শুক্রবার সকালে গাজীপুর প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিক ইউনিয়ন মানববন্ধন করে। তারা দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানায় এবং প্রশাসনের ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার তাহেরুল হক চৌহান বলেন, চিহ্নিত আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে এবং শিগগিরই সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।