সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে বিপর্যস্ত ব্যাংক খাতের রোগ নিরাময় করছে

গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আগস্টে যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশের ব্যাংক খাত তীব্র ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়া এবং কয়েক ডজন ব্যাংকের তারল্য সংকট নিয়ে জর্জরিত ছিল। এসব ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না।
ডলারের দর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০.৪৯ শতাংশে উঠে যায়।
তবে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া সংশোধনমূলক পদক্ষেপের ফলে গত এক বছরে এই বড় সমস্যাগুলোর বেশিরভাগেরই সমাধান হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে, স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে।
আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলারের বিনিময় হার—যা গত বছর ১২৮ টাকায় উঠে গিয়েছিল—এ বছরের জুলাইয়ে ১২০ টাকায় নেমে স্থিতিশীল হয়েছে। ডলারের প্রবাহ বাড়ার কারণে টাকার মানও বেড়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে গ্রস রিজার্ভ ১৮.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। সেখান থেকে রিজার্ভ ৬ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে এ বছরের জুলাইয়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতিতে উন্নতি হওয়ায় মূল্যস্ফীতি গত বছরের আগস্টের ১০.৪৯ শতাংশ থেকে কমে জুলাইয়ে ৮.৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, আগামী বছরের মার্চ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রমও শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, দুর্বল ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এনবিএফআই) একীভূত করার লক্ষ্যে ব্যাংকিং রেজোল্যুশন অ্যাক্ট প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতি রেখে ঋণ শ্রেণিকরণের নিয়মাবলি আধুনিকীকরণ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন।
গত বছরের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি ছিল 'কল্পনাতীত' এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণকে অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'অফিশিয়াল তথ্যে খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ দেখানো হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ভেবেছিলাম এটা হয়তো ২৫ শতাংশের কাছাকাছি হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র গোপন না করে তা প্রকাশ করছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঋণ শ্রেণিকরণের নিয়ম বাস্তবায়ন করেছে।
লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন
গভর্নর বলেন, প্রথম অগ্রাধিকার হলো: লুটপাটের শিকার হওয়া ১২-১৩টি ব্যাংককে পুনরুদ্ধার করা এবং আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া। এ লক্ষ্যে আইনগত সংস্কার আনা হচ্ছে। নতুন ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালা অনুসারে, এখন কোনো ঋণ ওভারডিউ হলেই তিন মাসের মধ্যে ঋণ ক্লাসিফাইড (শ্রেণিকৃত) হবে; আগে এ সময় ছিল ছয় মাস থেকে এক বছর।
তিনি বলেন, যেসব ব্যাংকের বোর্ড ও গভর্নেন্স ভালো ছিল, তাদের কোনো বড় ধরনের সমস্যা হয়নি। কাজেই, এখন লক্ষ্য হলো সুশাসন নিশ্চিত করা। যেসব ব্যাংক নিজে থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, সেগুলোকে মার্জারের (একীভূতকরণ) আওতায় নেওয়া হবে। তবে ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবির মতো কিছু ব্যাংক ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তবে কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এসব ব্যাংক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় এই ব্যাংকগুলোকে মার্জারের আওতায় নেওয়া পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই ব্যাংকগুলোকে আপাতত একীভূত করার পর কিছুদিন সরকারি ব্যাংক হিসেবে চালানো হবে। পরে সেগুলোকে বেসরকারি খাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখানে অংশ নেবেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার কিনতে পারবেন।
ব্যাংকের পর্ষদে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ কমানো
ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি সংশোধনীর ফলে একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ পরিচালকের সংখ্যা কমে চারজনে নেমে আসবে। অন্তত ৫০ শতাংশ পরিচালক হবেন স্বতন্ত্র; তাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত একটি প্যানেল থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
ঋণ আদায় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করা হচ্ছে। গভর্নর বলেন, খেলাপিরা হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এলেও তাদের খেলাপি হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্বগুলো সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ সংশোধন করতে হবে। সেখানে পরিষ্কারভাবে মূল লক্ষ্যগুলো সংজ্ঞায়িত করতে হবে।
এক নম্বর লক্ষ্য হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, এবং এটি থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে। 'যদি এই টার্গেট অর্জন না হয়, তাহলে সেটার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জবাবদিহি করতে হবে—"কেন পারলেন না, ব্যাখ্যা দিন।" সেটা হতে পারে বৈশ্বিক শক, যুদ্ধ বা মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে,' বলেন তিনি।
মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও মন্ত্রণালয়ের একটি শক্তিশালী যৌথ উপদেষ্টা কমিটি। 'এখনও একটা কমিটি আছে, তবে সেটা শক্তিশালী নয়। নতুন কমিটি হবে শক্তিশালী—যারা সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা মূল্যস্ফীতি কত রেঞ্জে রাখতে চাই এবং কী কী নীতি নিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির স্থান থাকবে না,' গভর্নর বলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বিতীয় লক্ষ্য হবে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা। গভর্নর বলেন, 'আমাদের দেশে এই খাতটাই সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যথাযথ ক্ষমতা দিতে হবে—প্রয়োজনে বোর্ড পরিবর্তন, ক্যাপিটাল বেইজ ঠিক করতে বলা, অথবা ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা।'
বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু
২০২৫ সালের ১৪ মে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তানুযায়ী বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা চালু করেছে। ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে দাম ঠিক করে ডলার লেনদেন করতে পারছে।
এই পদক্ষেপ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে। খোলাবাজারের দামের সঙ্গে অফিশিয়াল দামের পার্থক্য কমে আসায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা অর্থছাড় করতে শুরু করেছে। এর ফলে মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ পুনর্গঠনের জন্য ডলার কিনছে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পলিসি রেট বৃদ্ধি
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময়ে পলিসি রেট ছিল ৮.৫ শতাংশ। সেটিকে তিন ধাপে বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৪ সালের অক্টোবরে ১০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় চলতি বছরের মাঝামাঝি নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণের কথা জানিয়েছিলেন গভর্নর। সে লক্ষ্য যদিও পূরণ হয়নি, তবে গত জুনের মধ্যে তা ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
ব্যাংক একীভূতকরণ
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে। ব্যাংকগুলো হলো—ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি, ইউসিবিএল, এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি, আল-আরাফাহ ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, ন্যাশনাল, এনআরবি, এনআরবিসি, মেঘনা ও বিসিবিএল।
এখন খেলাপি ঋণ ৬০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাওয়া পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাঙ্কগুল হচ্ছে: সোশ্যাল ইসলামী, এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ।
ব্যাংক রেজোল্যুউশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫-এ ব্যাংক একীভূতকরণ ও অবসায়নের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতারণার মাধ্যমে তহবিল ব্যবহারের জন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করার বিধান রাখা হয়েছে।
পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে ধীরগতি
সম্পদ উদ্ধার-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠনের নয় মাস পরও বিদেশি আদালতে উপস্থাপন করার মতো আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য প্রমাণসহ একটি মামলাও প্রস্তুত করতে পারেনি বাংলাদেশ।
১১টি সংস্থা ও যৌথ তদন্তকারী দল নিয়ে গঠিত এই টাস্কফোর্স আন্তর্জাতিক সম্পদ চিহ্নিত করতে পারেনি। এর মূল কারণ দুর্বল সমন্বয় ও বৈশ্বিক মানদণ্ডের সাথে সংগতিপূর্ণ মামলা প্রস্তুত করার মতো দক্ষতার অভাব।
কী পরিমাণ পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব—এই প্রশ্নের জবাবে গভর্নর মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'আমি এখনই কোনো নির্দিষ্ট অঙ্ক বলতে চাই না। এই টাকার বেশিরভাগই এখনও "বার্ড ইন দ্য বুশ"— মানে খাঁচার বাইরের পাখি। যেটা খাঁচায় আছে, সেটা নিয়ে কিছু করা সম্ভব।'
তিনি বলেন, 'আমরা চেষ্টা করছি, কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছি—সম্পদ ফ্রিজিং, ট্র্যাকিং ইত্যাদির মাধ্যমে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য সম্পদ ফ্রিজ করে আটকে ফেলা, এরপর আইনগত প্রক্রিয়ায় টাকা ফেরত আনা। এই পুরো প্রক্রিয়ায় চার-পাঁচ বছর সময় লাগবে—এটাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড।'
তিনি স্বীকার করেন: 'সত্যি বলতে, এখানেই আমাদের কিছু ঘাটতি আছে। অনেকে বলেন, মরা কি ইচ্ছে করে ধীরগতি নিলাম? না, তেমন নয়। আমরা দুধরনের পথ বিবেচনায় রেখেছি: আইনি প্রক্রিয়া, যেটা অনেক দীর্ঘ; এবং দরকষাকষি প্রক্রিয়া, যেখানে আমরা আলোচনার মাধ্যমে কিছু অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করছি।'
গভর্নর আরও বলেন, অনেকেই এখনও দেশেই আছেন, কিন্তু তাদের সম্পদের একাংশ বিদেশে আছে। 'আমরা চাচ্ছি, দুষ্টচক্র ভেঙে, আলোচনার মাধ্যমে টাকাটা ফেরত আনতে।"
গভর্নর উল্লেখ করেন, ব্যাংক খাত থেকে আনুমানিক ১৭ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে—যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ।