ড্যাপ সংশোধন: ঢাকার কিছু এলাকায় ভবন নির্মাণে ফ্লোর এরিয়া রেশিও দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে

রাজধানীর ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ব্যাপকভাবে সংশোধন করছে সরকার। বর্তমান পরিকল্পনার তুলনায় এলাকাভিত্তিক ও আবাসিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) দুই গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
এর ফলে শহরের সব এলাকায়ই এখনকার তুলনায় বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণের সুযোগ তৈরি হবে। সংশোধিত ড্যাপে রাজধানীকে ৬৫টি জনঘনত্ব ব্লকে ভাগ করে নতুন এফএআর নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজউক সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
আগামীকাল রোববার (১০ আগস্ট) ড্যাপের সংশোধন এবং 'ঢাকা ইমারত বিধিমালা-২০২৫' চূড়ান্ত করা হবে। ইতোমধ্যে আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাব, নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব প্ল্যানার্স, রাজউক এবং উপদেষ্টা পরিষদের মতামত নিয়ে সংশোধিত ড্যাপের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। এখন কমিটির অনুমোদন নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
এর আগে, গত ৩ আগস্ট গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সভাপতিত্বে এ বিষয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে এটি আগামীকাল চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, জমির মালিক ও ডেভেলপারদের দাবি এবং ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে এফএআর বাড়িয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি করে কম জমিতে বেশি আয়তনের ভবন নির্মাণের সুযোগ থাকবে। এতে আবাসন ব্যবসায়ীরা ছোট প্লটে ভবন নির্মাণে আগ্রহী হবেন এবং ক্রেতা পর্যায়ে ফ্ল্যাটের দাম কমার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সরকার এফএআর বাড়াচ্ছে—যা নগরের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের মতে, সুবিধাভোগীদের স্বার্থে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত নয়।
এফএআর বা ফ্লোর এরিয়া রেশিও হলো একটি প্লটে কতটুকু জায়গা নিয়ে ভবন নির্মাণ করা যাবে তার অনুপাত। উদাহরণস্বরূপ– ১,০০০ বর্গফুট জমির এফএআর যদি ১.৫ হয়, তবে মোট ফ্লোর স্পেস হবে ১,৫০০ বর্গফুট। সেই প্লটে পাঁচতলা ভবন হলে প্রতিতল হবে ৩০০ বর্গফুট। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এফএআর শহর পরিকল্পনা ও ভবন নির্মাণের ঘনত্ব ও উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সংশোধিত ড্যাপে 'সেটব্যাক এলাকা' ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। সেটব্যাক এলাকা বলতে প্লটের যে অংশ ফাঁকা রেখে ভবন নির্মাণ করতে হয় সেটি বোঝায়।
পাশাপাশি আলো-বাতাস নিশ্চিত করতে দুটি ভবনের মধ্যে কৌণিক দূরত্ব কমপক্ষে ৭২ ডিগ্রি রাখার বিষয়টি বিবেচনা করছে রাজউক। যদিও নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, আদর্শ মান ৪৫ ডিগ্রি, কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবি—এটি মানলে ঢাকার আবাসন সুবিধা অর্ধেক কমে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বর্তমান ড্যাপ (২০২২–২০৩৫) কার্যকর করে গেজেট প্রকাশ করে। এরপর থেকেই আবাসন কোম্পানি ও জমির মালিকসহ বিভিন্ন পক্ষ এর সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছেও ডেভেলপার কোম্পানিগুলো বারবার এ দাবি জানায়। সর্বশেষ গত ২০ মে ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন রাজউকের প্রধান কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে এবং ড্যাপ সংশোধন না হলে রাজউকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়।
জানা গেছে, মালিকানা ও বসবাসের ধরন অনুযায়ী ইমারত বা ভবন ছয়টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।
এলাকা-ভিত্তিক পরিবর্তন
আবাসন ইউনিটের সর্বোচ্চ এফএআর নির্ধারণ করা হয়েছে ২.৩—যা রামপুরা, বাড্ডা, তেজগাঁও, তারাবো পৌরসভা, হেমায়েতপুর, সাভার পৌরসভা ও টঙ্গীতে প্রযোজ্য হবে। সর্বনিম্ন এফএআর ১.৬। এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ এফএআর নির্ধারণ করা হয়েছে গুলশান ও বনানীতে ৫.৫ এবং সর্বনিম্ন ২.০।
সূত্র জানায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এলাকাভিত্তিক এফএআর আগের মতোই ৪.১ রাখা হলেও আবাসন ইউনিটের এফএআর ১.৯ থেকে বাড়িয়ে ২.০ করা হচ্ছে। বারিধারার এলাকাভিত্তিক এফএআর ৪ থেকে বেড়ে ৪.৭ হলেও আবাসন এফএআর ১.৮ থেকে কমিয়ে ১.৭ করা হয়েছে।
গুলশান ও বনানীর এলাকাভিত্তিক এফএআর ৫.৭ থেকে কমিয়ে ৫.৫ করা হলেও আবাসন এফএআর ১.৭ থেকে বাড়িয়ে ২.০ করা হয়েছে। উত্তরা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের দুই ধরনের এফএআরই ০.২ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধানমন্ডির আবাসন এফএআর ১.৭ থেকে বাড়িয়ে ২.১ এবং জলসিড়ি আবাসিক এলাকার এফএআর ১.৬ থেকে বাড়িয়ে ২.১ করা হয়েছে।
পান্থপথ এলাকার দুই ধরনের এফএআরই বাড়ছে। মহাখালী, মহাখালী ডিওএইচএস ও নিকেতনের দুই ধরনের এফএআরই বাড়ানো হয়েছে। খিলক্ষেত আবাসিক এলাকার এলাকাভিত্তিক এফএআর ১.৪ থেকে বেড়ে ৪.২ এবং আবাসন এফএআর ১.২ থেকে বেড়ে ২.০ করা হয়েছে।
আফতাবনগর, বনশ্রী ও উত্তরা তৃতীয় পর্বের এফএআরও বাড়ানো হচ্ছে। মিরপুরের আবাসন এফএআর ১.৭ থেকে বাড়িয়ে ২.০ এবং এলাকাভিত্তিক এফএআর ২.৮ থেকে বাড়িয়ে ৩.৪ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ সেন্টার এলাকার আবাসন এফএআর ১.২ থেকে বেড়ে ২.১, ঝিলমিল আবাসিক এলাকায় ১.৬ থেকে বেড়ে ১.৯, রামপুরায় ১.৪ থেকে বেড়ে ২.৩, গ্রীন মডেল টাউনে ১.৫ থেকে বেড়ে ১.৯ এবং পূর্বাচলে ১.৬ থেকে বেড়ে ১.৯ করা হয়েছে।
তবে বিমানবন্দর এলাকার এফএআর এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
কি থাকছে ঢাকা ইমারত বিধিমালা ২০২৫-এ
জানা গেছে, 'ঢাকা ইমারত বিধিমালা ২০২৫'-এ বেশ কয়েকটি নতুন বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষের আওতাধীন যেকোনো স্থানে অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ বা ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনাবিদের অনুমোদন নিতে হবে।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, ৭০ শতাংশ বা ৪২.৪৩ কাঠা থেকে দেড় একরের কম জমিতে অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ বা ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের জন্য নগর পরিকল্পনাবিদের অনুমোদন লাগবে।
২০০৮ সালের বিধিমালায় এ ধরনের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা ছিল না। দেড় একরের বেশি জমিতে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের অনুমোদন নিতে হবে।
এছাড়া দেড় একরের বেশি জমিতে অ্যাপার্টমেন্ট বা ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন করতে হলে প্রয়োজন অনুযায়ী বেবিচক, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিআইডাব্লিউটিএ, কেপিআই ও হেরিটেজ কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র নিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও অবস্থানগত ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক হবে।
নতুন বিধিমালায় ঢালু ছাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিন্দুকে ভবনের উচ্চতা হিসেবে গণনা করা হবে। এছাড়া 'এট্রিয়া'—অর্থাৎ একাধিক তলাবিশিষ্ট বৃহৎ খোলা জায়গা—নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
নদীতীরবর্তী বা বন্যাপ্রবণ এলাকায় প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় বন্যার প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হবে কি না, পানির উচ্চতা বা গতিবেগ বাড়বে কি না এবং বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না—তা বিবেচনায় রাখতে হবে।
রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য যে প্লটের জমি অধিগ্রহণ করা হবে, সেই জমির মালিক তিন গুণ ক্ষতিপূরণ পাবেন।
এফএআর বাড়াতে চাপ দিচ্ছে ডেভেলপাররা
রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বেসিক বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল লতিফ টিবিএসকে বলেন, "ঢাকা শহরের আয়তনের তুলনায় মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই সবার জন্য নিরাপদ ও শোভন আবাসন নিশ্চিত করতে উঁচু ভবন নির্মাণের সুযোগ বাড়ানো জরুরি।"
তিনি বলেন, "এখন যে এফএআর নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটিও পর্যাপ্ত নয়। জমির বর্তমান দামে অন্তত সাততলা ভবন নির্মাণের সুযোগ না পেলে ব্যবসায়ীরা টিকতে পারবে না।"
"রাজধানীর ন্যূনতম এফএআর ৩.৫ থেকে ৪.০ হওয়া উচিত, যাতে ৪০ শতাংশ সেটব্যাক রেখে আটতলা ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়। সরকার যা করছে সেটি মন্দের ভালো; এফএআর বাড়ালে কোনো ক্ষতি হবে না, বরং স্বাস্থ্যসম্মত নগর গড়ে উঠবে," যোগ করেন তিনি।
রিহ্যাবের এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, ডেভেলপারদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য রাজউকের কিছু কর্মকর্তা, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে।
রাজউক বলছে, এত বড় একটি খাত পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তাই তাদের বিভিন্নভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু একটি সংস্থা প্রকাশ্যে এভাবে বলতে পারে না।
ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের প্রেসিডেন্ট আদিল মোহাম্মাদ খান টিবিএসকে বলেন, "ড্যাপ সংশোধনে আবাসন ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। তবে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও বসতি বিবেচনায় ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার ব্যবসায়ীদের প্রভাবে এমন উদ্যোগ নিচ্ছে যা অবকাঠামোর আরও বিস্তৃতি ঘটাবে।"
তিনি আরও বলেন, "সংশোধিত এফএআর অনুযায়ী উঁচু ভবনের সারি গড়ে উঠবে, এতে আলো-বাতাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে, যা পরিবেশের জন্য অনুকূল নয়। অনেক ভবনে আলো-বাতাসের ঘাটতি হবে, আকাশও দেখা যাবে না।"
এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, "বর্তমান এফএআরই শহরের জন্য যথেষ্ট। একসময় ধানমন্ডিতে ভবনের উচ্চতা ছিল ছয়তলা, পরে এফএআর পরিবর্তনের কারণে তা নয়তলা হয়েছে। এখন আরও বেশি উচ্চতার ভবন হবে, যা কাঠামোগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।"