রাশিয়াকে ঠেকাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম বিদেশের মাটিতে স্থায়ী সেনা মোতায়েন শুরু জার্মানির

রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসন প্রতিহত করতে বাল্টিক অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জার্মানি প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে স্থায়ীভাবে সেনা মোতায়েন করেছে। এর মাধ্যমে ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করা হচ্ছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়াস সম্প্রতি লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ইউনিটের যাত্রা ঘোষণা করেন। এসময় অনুষ্ঠানে লিথুয়ানিয়া, জার্মানি ও ইউক্রেনের পতাকা হাতে উপস্থিত ছিলেন দর্শনার্থীরা।
এই নতুন সশস্ত্র ইউনিটের নাম ৪৫তম ট্যাংক ব্রিগেড। এতে ৪ হাজার ৮০০ জার্মান সেনা এবং ২০০ বেসামরিক কর্মী থাকবে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর এই ব্রিগেড গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এটি পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চ্যান্সেলর মেৎর্স বলেন, 'আমাদের বাল্টিক মিত্রদের নিরাপত্তা মানেই আমাদের নিরাপত্তা। আমরা যে কোনও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোটের ভূখণ্ড রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাউসেদার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মেৎর্স বলেন, 'রাশিয়ার আগ্রাসী সংস্কারবাদ ইউরোপের মানচিত্র নতুন করে আঁকার চেষ্টা করছে—এটি কেবল ইউক্রেন নয়, বরং পুরো মহাদেশের জন্যই গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে।'
চ্যান্সেলর মেৎর্সের সফরের আগেই লিথুয়ানিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোভিলে শাকালিয়েনে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুরট আলগেমাইন পত্রিকাকে বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিস্তোরিয়াস বলেছিলেন রাশিয়া আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো একটি ন্যাটো রাষ্ট্রে আক্রমণ করতে সক্ষম হতে পারে―তার সেই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত তিনি।'
শাকালিয়েনে আরও বলেন, 'প্রতিটি লিথুয়ানিয়ান জানে: যদি রাশিয়ানরা আসে, তবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।'
২.৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ লিথুয়ানিয়া রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ এক্সক্লেভ এবং রুশ মিত্র বেলারুশের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। লিথুয়ানিয়ার অনুরোধে গঠিত হয়েছে এই নতুন ব্রিগেড। দেশটির প্রেসিডেন্ট নাউসেদা চ্যান্সেলর মেৎর্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, 'আমরা হুমকির প্রকৃতি বুঝি এবং আমাদের মিত্রদের সঙ্গে মিলেই এর মোকাবিলা করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।'
তিনি জানান, লিথুয়ানিয়া আগামী বছর প্রতিরক্ষাখাতে জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে, যা ন্যাটোর নতুন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জার্মানির জন্য বাল্টিক অঞ্চলে স্থায়ী সেনা মোতায়েন একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে শুধু লিথুয়ানিয়া নয়, প্রতিবেশী ন্যাটো সদস্য ইস্তোনিয়া ও লাটভিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও শক্তিশালী হবে। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকা এসব দেশ এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য এবং তারা রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলার ভয়ে রয়েছে।
এই অঞ্চলে সেনা মোতায়েন নিশ্চিত করতে জার্মানি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, বিশেষ করে পর্যাপ্ত সেনা সদস্য নিয়োগে। এ সমস্যার সমাধানে চলতি বছরের জানুয়ারিতে জার্মানির ৬৩০ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্ট বুন্ডেস্টাগ একটি আইন পাস করেছে, যেখানে কর্মঘণ্টা নমনীয় করা, বাড়তি ভাতা এবং ওভারটাইমের জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বুন্ডেসভেয়ারে (জার্মান সেনাবাহিনী) কাজ করা প্রথম চ্যান্সেলর হিসেবে মেৎর্স বলেন, 'আমরা ইউক্রেনের পাশে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা ইউরোপীয় হিসেবেও একত্রে থাকবো এবং যেখানেই সম্ভব, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দল হিসেবে কাজ করবো।'
তিনি জানান, ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে জার্মানি ২০৩২ সালের মধ্যে লিথুয়ানিয়ার মতোই প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে ৩.৫ শতাংশ যাবে সামরিক সরঞ্জাম কেনায় এবং ১.৫ শতাংশ অবকাঠামো—যেমন সড়ক, সেতু ও বন্দর—উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে।
জার্মানির প্রতিরক্ষা খাতে এই দৃঢ় অবস্থান ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। তারা এটিকে সাবেক চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের ঘোষিত প্রতিরক্ষা নীতি সাইটেনবেন্ডের (পরিবর্তনের মোড়) ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখছে। শলৎসের সরকার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য ১০০ বিলিয়ন ইউরোর একটি বিশেষ তহবিল গঠন করেছিল এবং জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করে ন্যাটোর প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিল।
তবে মেৎর্স আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে জার্মান সংবিধানে থাকা ঋণসীমা শিথিল করে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। গত সপ্তাহে সংসদে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি বলেন, 'বহু বছরের অবহেলার পর আমি ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলব।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের বন্ধু ও মিত্ররাও এটি আমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে—আসলে, তারা কার্যত এটি দাবি করে।'
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়াস বলেন, জার্মানি 'ন্যাটোর এক ইঞ্চি ভূখণ্ড রক্ষায়ও প্রস্তুত থাকবে'। তিনি লিথুয়ানিয়ায় মোতায়েনকৃত ব্রিগেডকে 'সম্ভাব্য যে কোনও প্রতিপক্ষের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা' হিসেবে অভিহিত করেন।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় মিত্রদের, বিশেষত জার্মানিকে, প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে আসছেন এবং প্রায়ই ওয়াশিংটনের ওপর 'ফ্রি লোডিং'-এর অভিযোগ এনেছেন।
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বার্তা দেওয়ায় ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে, ন্যাটোর পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার নিয়েও সংশয় বাড়ছে।
এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মেৎর্স বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে― এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো ইঙ্গিত নেই।'