রুশ উপকূলে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প; জাপান-রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রে সুনামি সতর্কতা জারি, সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাসিন্দাদের

রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের উপকূলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এর জেরে রাশিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ভূমিকম্পের পর এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের উপকূল ত্যাগ করে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল পেত্রোপাভলোভস্ক-কামচাটস্কি শহর থেকে প্রায় ১২৬ কিলোমিটার দূরে এবং এর গভীরতা ছিল ১৮ কিলোমিটার।
শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট সুনামির ঢেউ রাশিয়ার সেভেরো-কুরিলস্ক শহরের কিছু অংশ প্লাবিত করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির জরুরি পরিস্থিতি মন্ত্রণালয়। কুরিল দ্বীপপুঞ্জের এই ছোট বন্দর শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, শহরের উপকূলীয় এলাকায় ঢেউ উঠে ভেতরের দিকে পানি ঢুকে পড়ছে। এলাকাটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের তুলনামূলক কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে প্রভাব বেশি পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাখালিন অঞ্চলে উত্তর কুরিল দ্বীপপুঞ্জে সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়ার পর ওই এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
এএফপিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এলাকার মেয়র আলেকজান্ডার ওভসিয়াননিকভ জানান, সুনামির সতর্কতার পর যথেষ্ট সময় পাওয়া গিয়েছিল, এবং সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের হাতে এক ঘণ্টা সময় ছিল। সবারই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন সবাই সুনামি নিরাপত্তা জোনে অবস্থান করছে।'
এছাড়া ভূমিকম্পের পর কামচাটকা উপদ্বীপে ৩ থেকে ৪ মিটার উচ্চতার সুনামি আঘাত হানে বলে জানান অঞ্চলটির জরুরি বিষয়ক মন্ত্রী সের্গেই লেবেদেভ। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও একটি কিন্ডারগার্টেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছে।
কামচাটকার গভর্নর ভ্লাদিমির সলোদভ এই ভূমিকম্পকে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী উল্লেখ করে বলেন, 'আজকের ভূমিকম্পটি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ।'
রাশিয়ার কামচাটকা উপকূলে আঘাত হানা ভূমিকম্পটি আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-কম্পন ও ভূ-গঠন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলেন জানিসজিউস্কি বিবিসির নিউজডে প্রোগ্রামে বলেন, ভূমিকম্পটির মাত্রা একে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দশটি ভূমিকম্পের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
একইসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে, পরবর্তী এক মাস জুড়ে সেখানে ৭ দশমিক ৫ মাত্রা পর্যন্ত শক্তিশালী আফটারশক অনুভূত হতে পারে।
রুশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ভূভৌগোলিক সেবার কামচাটকা শাখা জানিয়েছে, 'আগামী অন্তত এক মাসের মধ্যে একাধিক শক্তিশালী ও স্পষ্ট অনুভূতিযোগ্য আফটারশক ঘটতে পারে।'
এর আগেও ভূমিকম্পে কেঁপেছে কামচাটকা অঞ্চল। গত ২০ জুলাইও পেত্রোপাভলোভস্ক-কামচাটস্কি শহরের কাছে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্পসহ পাঁচটি ভূকম্পন রেকর্ড করা হয়।
এই ধারাবাহিক ভূমিকম্প ও সুনামির আশঙ্কায় অঞ্চলটিতে সতর্কতা এবং জরুরি প্রস্তুতি জোরদার করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন জনসাধারণকে নিরাপদ স্থানে অবস্থান ও উপকূলীয় এলাকা এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮, যা ২০১০ সালের চিলির বিওবিও ও ১৯০৬ সালের ইকুয়েডরের এসমেরালদাসে হওয়া একই মাত্রার ভূমিকম্পের সঙ্গে যৌথভাবে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।
চিলির ওই ভূমিকম্প সম্পর্কে ইউএসজিএস জানায়, এটি কিরিহু শহরের উপকূলে আঘাত হানে, যাতে ৫২৩ জন নিহত ও ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
১৯০৬ সালের ইকুয়েডর-কলম্বিয়া ভূমিকম্প সম্পর্কে সংস্থাটি জানায়, প্রবল সুনামিতে ওই সময় ১,৫০০ মানুষ নিহত হয়েছিলে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ইতিহাসের পঞ্চম সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পও ঘটেছিল রাশিয়ার কামচাটকা অঞ্চলে, ১৯৫২ সালে। সেটি ছিল বিশ্বের প্রথম রেকর্ডকৃত ৯ মাত্রার ভূমিকম্প। সেই ভূকম্পনে সৃষ্টি হওয়া সুনামি হাওয়াইয়ে আঘাত হেনে ১০ লাখ ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি করেছিল।

জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রেও সতর্কতা জারি, সরিয়ে নেয়া হলো ২০ লাখ বাসিন্দাকে
ভূমিকম্পের পর জাপানের হোক্কাইডো থেকে কিউশু পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় সুনামি সতর্কতা জারি করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য অঞ্চলে দেওয়া হয়েছে নিম্নমাত্রার সতর্কতা। ইতোমধ্যে হোক্কাইডোর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরনগরী নেমুরোতে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার উচ্চতার ঢেউ আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে জাপানের জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে। তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরবর্তী ঢেউগুলো আরও বেশি উচ্চতার হতে পারে।
সুনামি সতর্কতার কারণে ১৯ লাখেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে শুধু হোক্কাইডোতেই প্রায় ১০ হাজার ৫০০ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, হোক্কাইডোতে বহু মানুষকে একটি ছাদের উপর জড়ো হতে দেখা গেছে।
টোকিওর দক্ষিণে চিবা এলাকার একটি সৈকতের পাশের অবজারভেটরিতেও অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জাপানের পূর্ব উপকূলজুড়ে বাসিন্দাদের উঁচু স্থানে সরে যাওয়ার আহ্বান অব্যাহত রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
জাপানের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলজুড়ে এখন পর্যন্ত একাধিক সুনামি ঢেউ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
জাপানের আবহাওয়া সংস্থা জানিয়েছে, এসব ঢেউয়ের উচ্চতা সর্বোচ্চ ৩ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনায় জনগণকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
জাপানের উপকূলে সুনামি সতর্কতার প্রেক্ষিতে ফুকুশিমার দাইইচি ও দাইনি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদের নিরাপদ উঁচু স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (টিইপিসো)।
২০১১ সালের ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ও সুনামির পর ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল ফুকুশিমা দাইইচি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
টিইপিসো জানিয়েছে, বর্তমান সুনামি সতর্কতার পর বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি থেকে কোনো ধরনের আহত বা অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে তারা সতর্ক রয়েছে এবং সুনামি সতর্কতা অব্যাহত থাকবে কিনা, তা তারা নিবিড়ভাবে নজরদারি করছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পুরো পশ্চিম উপকূল, আলাস্কার আলেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কিছু অংশ, হাওয়াই ও গুয়ামে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে এসব অঞ্চলের নিচু এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
রাশিয়ার উপকূলে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট সুনামি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ও ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু এলাকায় বন্দরের অবকাঠামো ও উপকূলবর্তী সম্পত্তির ক্ষতি করতে পারে বলে জানিয়েছেন খ্যাতনামা ভূকম্পবিদ ড. লুসি জোনস। তবে তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকার কোথাও এই সুনামিতে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা নেই।
হাওয়াইয়ে সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা হতে পারে ৩ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত, আর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারায় ঢেউয়ের সম্ভাব্য উচ্চতা ১ থেকে ২ ফুট বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলকভাবে ২০১১ সালের জাপানের ভূমিকম্পে ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল ৪২ ফুট পর্যন্ত, উল্লেখ করেন ড. জোনস।
তিনি বলেন, 'এটা কোনও ঢেউ নয়, এটা সাময়িকভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া।'
উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার ক্রিসেন্ট সিটি বন্দরে ৬ ফুট উচ্চতার ঢেউ আঘাত হানতে পারে বলে জানান তিনি। যদিও ক্যালিফোর্নিয়া কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের তুলনায় দূরে, তথাপি সমুদ্রের ঢেউ তৈরির নির্দিষ্ট প্যাটার্নের কারণে সেখানে ঢেউয়ের উচ্চতা তুলনামূলক বেশি হতে পারে।
লস অ্যাঞ্জেলস উপকূলের কাছে ক্যাটালিনা দ্বীপের এক ক্যাম্প কাউন্সেলরের সঙ্গেও কথা বলেছেন ড. জোনস, যেখানে স্থানীয় সময় রাত ১টার দিকে (গ্রিনিচ মান সময় সকাল ৯টা) ঢেউ আঘাত হানতে পারে।
তিনি বলেন, 'ওরা এখনো সরিয়ে নিচ্ছে না, তবে সামান্য হলেও হুমকি থাকায় ক্যাম্পারদের উপকূলবর্তী কেবিন থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।'
সতর্কতা হিসেবে হাওয়াই ও ক্যালিফোর্নিয়ায় জরুরি ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে এবং স্থানীয়দের সমুদ্রের ধারে না যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।