এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় রুশ যুদ্ধবিমান, ন্যাটোর জন্য সতর্ক সংকেত

রাশিয়ার তিনটি যুদ্ধবিমান শুক্রবার এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশ করে ১২ মিনিট অবস্থান করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। তারা এ ঘটনাকে 'অসীম দুঃসাহসী' অনুপ্রবেশ বলে অভিহিত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার এমন একাধিক সামরিক তৎপরতা ন্যাটোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
তবে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, যুদ্ধবিমানগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে নিরপেক্ষ জলসীমার ওপর দিয়ে উড়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা জোটের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তপ্ত সম্পর্কের মধ্যেই গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর রাতে ২০টিরও বেশি রুশ ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। ন্যাটোর যুদ্ধবিমান এর মধ্যে থেকে কিছু ড্রোন ভূপাতিত করে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা মনে করছেন, এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাশিয়া ন্যাটোর প্রস্তুতি ও সংকল্প পরীক্ষা করছে।
রাশিয়া ও বেলারুশের যৌথ সামরিক মহড়া 'জাপাদ-২০২৫' শেষ হওয়ার তিন দিন পরই এই অনুপ্রবেশ ঘটে। মহড়ায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুশীলনও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিন জানায়, মিগ-৩১ মডেলের তিনটি যুদ্ধবিমান অনুমতি ছাড়াই আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং প্রায় ১২ মিনিট অবস্থান করে। এই সময়ে দ্রুতগতির বিমানগুলো দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা অতিক্রম করতে পারত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগুস তসাকনা বলেন, 'রাশিয়া এ বছর এর আগেও চারবার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, যা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু আজকের অনুপ্রবেশ ছিল সবচেয়ে বেপরোয়া।'
রুশ যুদ্ধবিমান সাধারণত বাল্টিক সাগরের ওপর দিয়ে মূল ভূখণ্ড ও কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলের মধ্যে চলাচল করে।
শনিবার সকালে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের বিমানগুলো নির্ধারিত রুটেই উড়েছে এবং অন্য কোনো দেশের সীমানা লঙ্ঘন করেনি।
তারা টেলিগ্রামে জানায়, 'মিগ-৩১ যুদ্ধবিমানগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে নিরপেক্ষ জলসীমার ওপর দিয়ে উড়েছে এবং স্বাধীন পর্যবেক্ষণেও সীমালঙ্ঘনের প্রমাণ মেলেনি।'
পোল্যান্ড একই দিন জানায়, বাল্টিক সাগরে পেট্রোবাল্টিক ড্রিলিং প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা জোনে রাশিয়ার দুটি যুদ্ধবিমান প্রবেশ করেছে।
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
এ ঘটনার সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত নন, তবে শিগগির বিস্তারিত জানবেন।
তিনি বলেন, 'এটা আমার ভালো লাগছে না। বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।'
পোল্যান্ডে ড্রোন অনুপ্রবেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনো বিবৃতি দেয়নি, যা ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে রাশিয়ার হামলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে থাকবে কি না, তা নিয়ে।
ন্যাটো এক বিবৃতিতে জানায়, 'রুশ যুদ্ধবিমান আজ এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ন্যাটো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং যুদ্ধবিমানগুলোকে বাধা দিয়েছে। এটি রাশিয়ার বেপরোয়া আচরণের আরেকটি উদাহরণ।'
ইইউ'র পররাষ্ট্রনীতির প্রধান কাইজা কাল্লাস বলেন, 'এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়।'
এস্তোনিয়া জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার শীর্ষ কূটনীতিককে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং একটি কূটনৈতিক নোট হস্তান্তর করেছে।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টেন মিখাল জানান, তারা ন্যাটো চুক্তির ৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজনৈতিক আলোচনাশুরু করার জন্য অনুরোধ জানাবে।
তিনি বলেন, রুশ বিমানগুলো প্রায় ৯ কিলোমিটার (৫ নটিক্যাল মাইল) পর্যন্ত আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল। পরে এস্তোনিয়ায় অবস্থানরত ইতালির এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানগুলো তাদের সরে যেতে বাধ্য করে।
ন্যাটো 'বাল্টিক সেন্ট্রি' মিশনের অংশ হিসেবে এস্তোনিয়া ও অন্যান্য বাল্টিক দেশের আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ করে।
তসাকনা জানান, 'এটি ছিল স্পষ্ট উসকানি। ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। এ কারণেই আমরা ৪ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় আলোচনার আহ্বান জানিয়েছি।'
তিনি আরও জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি আকাশ প্রতিরক্ষা সহায়তা চাই।
ন্যাটো চুক্তির ৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সদস্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ভূখণ্ড বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়লে সদস্যরা একত্র হয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
ইউক্রেন এ ঘটনাকে রাশিয়ার আরেকটি অগ্রহণযোগ্য উসকানিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং এস্তোনিয়ার পাশে থাকার অঙ্গীকার জানিয়েছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, 'জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।'
লিথুয়ানিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোভিলে সাকালিয়েনে বলেন, ন্যাটোর উচিত দ্রুত সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা।
ফ্লাইট পরিকল্পনা ছিল না, ট্রান্সপন্ডার বন্ধ
এস্তোনিয়া জানায়, শুক্রবার সকালে তাল্লিন থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের ভায়ন্ডলু দ্বীপ এলাকার ওপর এ অনুপ্রবেশ ঘটে।
বিমানগুলো কোনো ফ্লাইট পরিকল্পনা ছাড়াই উড়ছিল, তাদের ট্রান্সপন্ডার বন্ধ ছিল এবং তারা বিমান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
এ ধরনের অনুপ্রবেশ ভায়ন্ডলু দ্বীপের ওপর মাঝে মাঝে ঘটে থাকলেও শুক্রবারের অনুপ্রবেশ তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী ছিল।
এক মার্কিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এটি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তা বলা কঠিন।'
নরওয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষক জাকুব এম. গোডজিমিরস্কি বলেন, 'ঘটনাটি একটি পরীক্ষা হতে পারে, তবে তা কাকতালীয়ও হতে পারে। তবে এটা এমন এক প্রেক্ষাপটে ঘটেছে, যেখানে মাত্র কয়েক দিন আগেই পোল্যান্ডে ড্রোন অনুপ্রবেশ ঘটেছে।'
এর আগে, গত মে মাসে এস্তোনিয়া জানিয়েছিল, রাশিয়ার একটি ফাইটার জেট বাল্টিক সাগরে ন্যাটোর আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। ওই সময় একটি রাশিয়ামুখী তেলবাহী ট্যাঙ্কারকে আটকানোর চেষ্টা চলছিল, যা রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা এড়াতে গঠিত 'ছায়া বহরের' অংশ বলে সন্দেহ করা হয়েছিল।