আকাশযুদ্ধে কোন যুদ্ধবিমান সেরা—জে-১০সি, রাফাল না-কি এফ-১৬?

আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে আকাশের দখল নেওয়া মানেই কৌশলগত জয়। সেই লড়াইয়ে বেশ আলোচিত তিনটি যুদ্ধবিমান হলো চীনের জে-১০সি, ফ্রান্সের রাফাল, এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন। অনেক দিন ধরেই এই ফাইটার জেটগুলো নিয়ে নানা তুলনা আর বিশ্লেষণ চলছিল, তবে ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার পর থেকে নতুন করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে উঠল।
পাকিস্তান যখন চীনের তৈরি জে-১০সি দিয়ে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করল, তখনই শক্তি আর সক্ষমতায় কোন ফাইটার জেট সেরা- তা নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক।
চীনের তৈরি জে-১০সি হলো চেংডু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপের একটি চতুর্থ প্রজন্মের মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। ২০১৮ সালে জে-১০-এর উন্নত 'সি' সংস্করণ বাজারে আসে। এই বিমানটির সর্বোচ্চ গতি ২ দশমিক ২ মাক (শব্দের গতির ২.২ গুন), যা ঘণ্টায় প্রায় ২ হাজার ৪১৫ কিমি। এটি ১ হাজার ৮৫০ কিমি পর্যন্ত কমব্যাট রেডিয়াসে (অভিযান সীমা) অপারেশন চালাতে পারে।

এই বিমান ২৩ মিমি অটোম্যাটিক কামান, পিএল-১৫ই এবং পিএল-১০ ক্ষেপণাস্ত্র, কেডি-৮৮ এয়ার টু সারফেস (আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য) ক্ষেপণাস্ত্র এবং জিপিএস ও লেজার নিয়ন্ত্রিত বোমা বহন করতে পারে।
এটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো উন্নত 'একটিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যান্ড এরে' রাডার, নিজস্ব জ্যামিং প্রতিরোধী যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং হেভি পে-লোড বহনের ক্ষমতা। চীন এবং পাকিস্তান বর্তমানে এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে।
সরঞ্জামভেদে প্রতি ইউনিট জে-১০সি এর দাম ৪০ থেকে ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে, রাফাল ফ্রান্সের দাসোঁ এভিয়েশনের তৈরি একটি ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, যার কার্যক্রম শুরু হয় ২০০১ সালে। এই যুদ্ধবিমানটি ১ দশমিক ৮ মাক গতি অর্জন করতে পারে (ঘণ্টায় প্রায় ২ হাজার ২২৩ কিমি) এবং এর কমব্যাট রেঞ্জ ১ হাজার ৮৫০ কিমি।
বহুমুখী অস্ত্রবহনে সক্ষমতা রাফালকে 'ওমনি-রোল' ফাইটার হিসেবে বিশেষ করে তোলে, কারণ একই মিশনে এটি আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে স্থলে এবং আকাশ থেকে সমুদ্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
এটি মেটিওর নামের দীর্ঘপাল্লার এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল এবং মাইকা নামের শর্ট ও লং রেঞ্জ মিসাইল ব্যবহার করতে পারে। স্থল আক্রমণে রকেট-চালিত গাইডেড বোমা হ্যামার , দীর্ঘপাল্লার ক্রুজ মিসাইল—স্ক্যাল্প, এবং লেজার নিয়ন্ত্রিত বোমা বহনে সক্ষম।

সমুদ্র যুদ্ধের জন্য রাফাল বহন করে একজোসেট এএম-৩৯ অ্যান্টি-শিপ মিসাইল। এছাড়া এতে প্রতি মিনিটে ২ হাজার ৫০০ রাউন্ড ছুঁড়তে সক্ষম নেক্সটার ৩০ মিলিমিটার ক্যাননও রয়েছে। এই বহুমুখী অস্ত্রসজ্জার কারণেই রাফাল এখন বিভিন্ন দেশের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে।
২০২৫ সালে ভারত ২৬টি রাফাল এম (নৌবাহিনীর জন্য) কেনার জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে, যার ফলে ভারতের জন্য প্রতিটি বিমানের গড় দাম প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে । এর আগে ভারত ৩৬টি 'রাফাল' যুদ্ধবিমান অর্ডার দিয়েছিল বলে জানিয়েছে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দাসো অ্যাভিয়াসিওঁ (দাসো এভিয়েশন)।
এদিকে, এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের তৈরি অন্যতম সফল মাল্টিরোল ফাইটার, যার প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। একক ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই বিমানটির সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ২ (ঘণ্টায় প্রায় ২ হাজার ৪১৪ কিমি) এবং রেঞ্জ ১ হাজার ৭০০ কিমি।
এটি সজ্জিত ২০ মিমি এম৬১এ১ ভালকান কামান, এআইএম-১২০, এএমআরএএএম, এআইএম-৯ সাইডউইন্ডার মিসাইল; সঙ্গে জেডিএএম, পেইভওয়ে এবং জিবিইউ সিরিজের বোমা। সর্বশেষ সংস্করণে ব্যবহৃত হয় এএন/এপিজি-৮৩ 'একটিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যান্ড এরে' রাডার।
১৯৭৬ সালে উৎপাদনের অনুমোদনের পর থেকে ৪,৬০০ টিরও বেশি এফ-১৬ নির্মিত হয়েছে। তবে মার্কিন বিমানবাহিনী এখন আর এটি কেনে না। বিভিন্ন দেশের কাছে এর উন্নত সংস্করণ বিক্রি করা হয়। বিশ্বজুড়ে ২৫টিরও বেশি দেশ এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রধান ব্যবহারকারী পাকিস্তান। প্রতি ইউনিটের ভিত্তি দাম ৬০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে হয়ে থাকে।

১৯৮৩ সালে প্রথম এফ-১৬-এর ডেলিভারি পায় পাকিস্তান। বর্তমানে দেশটির মোট যুদ্ধবিমানের মধ্যে প্রায় ৭৫টি হলো এফ-১৬। এগুলো কেনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
২০১৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য আটটি এফ-১৬ ব্লক ৫২ (দুইটি সি ও ছয়টি ডি মডেল) যুদ্ধবিমান বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়। এই চুক্তির মোট মূল্য ছিল প্রায় ৬৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ৫৬৪ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার ছিল প্রধান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য।
ডিফেন্স সিকিউরিটি কো-অপারেশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান এই চুক্তির জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়েছিল, কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে, ফলে পুরো খরচ পাকিস্তানকেই বহন করতে হয় ।
২০২২ সালে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের এফ-১৬ বহরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সহায়তার জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি অনুমোদন করে। ২০২৫ সালে পাকিস্তানকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আরও প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।
উল্লেখ্য, এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ছাড়াও পাকিস্তান চীন-পাকিস্তান যৌথভাবে নির্মিত জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে, যার ইউনিট মূল্য প্রায় ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তবে শুধু গতি বা অস্ত্র বহনের ক্ষমতা নয়—একটি যুদ্ধবিমানের কার্যকারিতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, টেকসই ব্যবহার এবং দামের বিপরীতে পারফরম্যান্সও গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিক থেকে জে-১০সি তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হওয়ায় 'ভ্যালু ফর মানি' হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পাকিস্তান যে সংস্করণের এফ-১৬ ব্যবহার করে, তার দাম ৬০ থেকে ৮৭ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। অন্যদিকে, ভারতের প্রতিটি রাফাল জেট কিনতে হয়েছে ৯০ থেকে ১১০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে।
সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো—পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা চীনের তৈরি জে-১০সি ব্যবহার করে তিনটি রাফাল, একটি মিগ-২৯ এবং একটি সুখোই-৩০ ভূপাতিত করেছে। যদি এই দাবি সত্য হয়, তবে এটি হবে জে-১০সি-এর প্রথম আকাশযুদ্ধে সফলতা এবং রাফালের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্র ধ্বংস।
প্রতিটি রাফাল জেটের দাম ২৮৮ মিলিয়ন ডলার হিসেবে ধরলে, তিনটি রাফাল ভূপাতিত হওয়ায় ভারতের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৬৫.৩৮ মিলিয়ন ডলার। মিগ-২৯ (৪৮ মিলিয়ন) ও সুখোই-৩০ (৫০ মিলিয়ন) ধ্বংস হওয়ায় অতিরিক্ত ক্ষতি হয়েছে আরও ৯৮ মিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে, মাত্র একদিনের আকাশযুদ্ধে ভারতকে প্রায় ৯৬৩ মিলিয়ন ডলারের সামরিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি এসেছে রাফাল যুদ্ধবিমানের—অত্যধিক ব্যয়ই এর কারণ।
সামগ্রিকভাবে, যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্তে কেবল প্রযুক্তি নয়, খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ, এবং বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকারিতাও বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সে দিক থেকে, জে-১০সি কম দামে শক্তিশালী পারফরম্যান্স দেখিয়ে বাস্তব যুদ্ধেই নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ রাখল।