বসের মুখোমুখি হতে চান না? জাপানে আপনার হয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার লোকও ভাড়ায় মেলে

শোতা শিমিজু কানে হেডসেট চাপিয়ে তার মক্কেলের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান, একটি নার্সিং কেয়ার কোম্পানির মানবসম্পদ বিভাগে ফোন করলেন। মক্কেল তার চাকরিটা ছাড়তে চান, আর তার হয়ে সেই কাজটাই করে দিচ্ছেন শিমিজু।
'চাকরির বাস্তবতার সঙ্গে তার প্রত্যাশার মিল ছিল না,' মানবসম্পদ বিভাগের প্রতিনিধিকে বললেন শিমিজু। 'তার কাছে এখনও কোম্পানির ইউনিফর্ম আর লকারের চাবি আছে, ওগুলো তিনি ডাকে পাঠিয়ে দেবেন। আপনাদের ডাকযোগে পাঠানোর ঠিকানাটা কি নিশ্চিত করবেন?'
শিমিজু টোকিও-ভিত্তিক 'ইস্তফা কোম্পানি' মোমুরি-তে কাজ করেন। বসের সঙ্গে অস্বস্তিকর কথোপকথন এড়াতে চান, এমন মক্কেলদের হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন এ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।
মোমুরি—যার অর্থ 'আমি আর পারছি না'—জাপানে গড়ে ওঠা এই বিশেষ, কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় শিল্পের একটি অংশ। এখানকার 'প্রক্সি পদত্যাগকারী' কর্মীরা এমন সব চাকরিজীবীদের পাশে দাঁড়ান, যারা তাদের বসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হিমশিম খান। মক্কেলের হয়ে পদত্যাগের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ৩৫০ ডলার (বা ৫০ হাজার ইয়েন) পর্যন্ত ফি নিয়ে থাকে।
মহামারির পর থেকে এই পরিষেবার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। মহামারি জাপানের কঠোর কর্মসংস্কৃতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে, চ্যালেঞ্জে ফেলেছে 'স্যালারিম্যান' বা চিরাচরিত চাকুরিজীবীর ধারণাকে। জাপানে এই স্যালারিম্যানরাই হলেন সেই চেনা ছকের কর্মী, যারা কলেজ শেষ করে একটি কোম্পানিতে যোগ দেন এবং অবসর পর্যন্ত সেখানেই থেকে যান। জাপানি কর্পোরেট জগতের কঠোর পদমর্যাদাক্রমও কর্মীদের জন্য সরাসরি বসের মুখোমুখি হওয়াকে কঠিন করে তোলে।
কিছু কর্মী কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা বা উত্যক্ত হওয়ার কারণে এই পরিষেবা ব্যবহার করেন। আবার কেউ কেউ সাহস করে পদত্যাগ করতে গিয়ে বা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে এই পথে হাঁটেন। অনেকে আবার এমন বসের সঙ্গে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে চান, যিনি সহজে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে চান না।
বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের মতোই জাপানের বিশ ও ত্রিশের কোঠায় থাকা তরুণদের মধ্যেও চাকরি ছাড়াটা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এমনকি মাঝবয়সি কর্মীদের মধ্যেও চাকরি বদলের এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ জাপানে একসময় ৩৫ বছর বয়সের পর চাকরি বদলানো প্রায় অসম্ভব মনে করা হতো। এর একটি কারণ ছিল উচ্চ পদে চাকরির সুযোগ কমে আসা।

দশকের পর দশক ধরে জাপানের শ্রমবাজারের বৈশিষ্ট্য ছিল আজীবন চাকরির নিশ্চয়তা, চাকরির মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে বেতন এবং কাজের পর বসের সঙ্গে বাধ্যতামূলক সামাজিকতাসহ কঠোর ও দীর্ঘ কর্মঘণ্টা। এই সংস্কৃতি যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিকশিত হয় এবং ১৯৮০-র দশকের অর্থনৈতিক স্বর্ণযুগে ফুলেফেঁপে ওঠে।
১৯৯০-এর দশকে জাপানের 'বাবল ইকোনমি' বা বুদবুদ অর্থনীতির পতনের পর থেকে আজীবন চাকরি ও মেয়াদের ভিত্তিতে বেতনের ধারণা ফিকে হতে শুরু করে। তবে দীর্ঘ কর্মঘণ্টার সংস্কৃতি বদলায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপান এখন দ্রুত বয়োবৃদ্ধ ও সংকুচিত হতে থাকা শ্রমশক্তির মুখোমুখি হওয়ায় কর্মীদের হাতে বিকল্প জায়গায় কাজ খুঁজে নেওয়ার সুযোগ বেড়েছে। কর্মীরাও এখন জাপানি কর্পোরেট সংস্কৃতির পরিচায়ক হয়ে ওঠা পুরোনো রীতিনীতির—যেমন মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘ কর্মঘণ্টা—প্রতি সহনশীলতা হারাচ্ছেন। এ সংস্কৃতিতে অসন্তুষ্ট হলে নতুন চাকরি খুঁজে নিতে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন তারা।
টোকিওর ইনডিড রিক্রুট পার্টনার্স রিসার্চ সেন্টারের প্রধান গবেষক কাওরু সুদা বলেন, 'এখন শ্রমবাজারে নানা ধরনের চাকরির সুযোগ রয়েছে, যা কর্মীদের আগের চেয়ে অনেক বেশি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিচ্ছে।'
পঁচিশ বছর বয়সি তোউই ইদা (ছদ্মনাম) তার রক্ষণাবেক্ষণ কোম্পানিতে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি জানান, তার বস তার উদ্বেগগুলোকে মোটেও গুরুত্ব দেননি। তাই চাকরি ছাড়ার জন্য তিনি অন্য একজনকে ভাড়া করেন।
ইদা বলেন, 'পদত্যাগপত্রটি গৃহীত হয়েছে—এই খবরটা পাওয়ার পর আমি কী যে স্বস্তি পেয়েছিলাম, তা বলে বোঝাতে পারব না।' ইদা নিজেই এখন মোমুরিতে কাজ করেন, কারণ তিনিও অন্যদের চাকরি ছাড়তে সাহায্য করতে চান।
অবশ্য জাপানে চাকরি বদলানোর এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ঘটনা এখনও বেশ বিরল। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে দেশটিতে প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন মানুষ চাকরি বদলেছেন—যা ওই বছরের প্রায় ৬৮ মিলিয়ন চাকরিজীবীর অতি সামান্য একটি অংশ। জাপান সরকারের প্রকাশিত ২০২২ সালের একটি শ্বেতপত্র অনুসারে, অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) দেশগুলোর গড়ের তুলনায় জাপানে চাকরি পরিবর্তনের হার ঐতিহাসিকভাবেই কম।
টোকিওর তাইশো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসংস্থান প্রবণতা বিষয়ক গবেষক সুগুও এবিহারা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি চাকরি ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয় বলে বড় কর্পোরেশন, প্রধান ব্যাংক ও ট্রেডিং কোম্পানিগুলো এখনও কলেজ স্নাতকদের জন্য কর্মজীবনের আকর্ষণীয় গন্তব্য।
তা সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে চাকরি বদলাতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে বলে জানান গবেষক সুদা। তিনি আরও বলেন, চাকরি পরিবর্তনের মাধ্যমে এখন বেশি মানুষ বেতন বৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছেন, যা জাপানের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ দেশটিতে গত তিন দশকের বেশিরভাগ সময় ধরেই মজুরি প্রায় স্থির রয়েছে।
কিন্তু জাপানের মতো একটি দেশে—যেখানে প্রায়ই ব্যক্তিগত অনুভূতিকে বিসর্জন দিয়ে সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতিকে মূল্য দেওয়া হয়—নিজের অসন্তুষ্টির কথা বসকে খুলে বলা সহজ কাজ নয়। নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক কেইকো ইশিই বলেন, সম্ভবত এ কারণেই মানুষ পদত্যাগকারী সংস্থাগুলোর দিকে ঝুঁকছে।

ইশিই বলেন, 'মানুষ প্রায়ই তাদের মনের আসল কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ধৈর্যের বাঁধ যখন ভেঙে যায়—যখন তারা ভাবে, "আমি আর নিতে পারছি না"—তখন হয়তো তারা নিজেরা কথাটা বলতে পারে না। সম্ভবত এ কারণেই পদত্যাগকারী সংস্থার মতো ব্যক্তিগত সহায়তাকারী পরিষেবাগুলো আকর্ষণীয় মনে হতে শুরু করে।'
টোকিও শোকো রিসার্চের ২০২৪ সালের সমীক্ষা অনুসারে, জাপানের প্রতি ১০টি কোম্পানির মধ্যে প্রায় একটি কোম্পানি প্রক্সি পদত্যাগকারীর মাধ্যমে পদত্যাগপত্র পেয়েছে। ঠিক কতজন মানুষ এই পরিষেবা ব্যবহার করেন, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ইস্তফা কোম্পানি মোমুরি ও অন্যান্য সমীক্ষার তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, গত কয়েক বছরে হাজার হাজার জাপানি এই পরিষেবা ব্যবহার করেছেন।
মোমুরির প্রেসিডেন্ট শিনজি তানিমোতো জানান, ২০২২ সালে ব্যবসা শুরুর সময় তার কোম্পানি মাসে প্রায় ২০০টি কাজ পেত, যা এখন বেড়ে প্রায় ২ হাজার ৫০০-তে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, তার মক্কেলদের প্রায় ৮০ শতাংশই ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সি। তবে তার চেয়ে বেশি বয়সি মক্কেলও তিনি পেয়েছেন, যার মধ্যে একজন ৮৩ বছর বয়সিও ছিলেন।
প্রক্সি পদত্যাগকারীরা সাধারণত মানবসম্পদ বিভাগে ফোন করে তাদের মক্কেলের পদত্যাগের খবরটি পৌঁছে দেন। তবে চাকরি ছাড়ার শর্ত নিয়ে দর-কষাকষিতে তারা জড়ান না। আইনি পরামর্শ দেওয়া বা বিচ্ছেদকালীন পাওনা নিয়ে দর-কষাকষির মতো আইনি এখতিয়ারের বাইরে যাওয়ায় কোনো কোনো পদত্যাগ কোম্পানি টোকিও বার অ্যাসোসিয়েশনের সমালোচনার মুখেও পড়েছে।
মধ্য জাপানের আইচি প্রিফেকচারে অবস্থিত ওইতোমা এজেন্সিতে পদত্যাগ পরিষেবা চালান তাইশি কুসানো। তিনি জানান, তার অনেক মক্কেলই সরাসরি বসের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে কর্মক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেই বেশি পছন্দ করেন।
তিনি বলেন, প্রক্সি পদত্যাগকারীর ফোন পেয়ে কোম্পানিগুলোও কখনও কখনও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়।
'প্রতিক্রিয়ার একটা পরিচিত ধরন আছে: প্রথমে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তারপর রেগে যায়। অনেক ম্যানেজার হয়তো হতাশ হন এই ভেবে যে, কর্মচারী সরাসরি তাদের কাছে কেন এল না। আবার কেউ কেউ হঠাৎ করে কর্মী চলে যাওয়ায় নিজেদের কর্মদক্ষতার সূচক খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় ভোগেন,' বলেন তিনি।
'তবে আজকাল এই ধারণাটি অনেক বেশি পরিচিত। তাই "ওহ, আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি"—এরকম প্রতিক্রিয়াও এখন প্রায়শই দেখা যায়।'
গবেষক সুদা বলেন, চাকরি ছাড়াটা সহজ হয়ে যাওয়ায় এখন কোম্পানিগুলোকেও কর্মী আকর্ষণ করা, ধরে রাখা ও পারিশ্রমিক দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, কিছু কোম্পানি এখন নিজেদেরকে এমনভাবে বদলাচ্ছে, যাতে তারা নতুন কর্মীদের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে।
কেনতো সানো ৩১ বছর বয়সে একটি বড় ভ্রমণ কোম্পানিতে চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর কী করতে চান, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে ছিল বাগান করা, ফ্রিল্যান্সিং ও বইয়ের দোকানে কাজ করা।
শেষ পর্যন্ত তিনি আবার ভ্রমণ শিল্পেই ফিরে আসেন, তবে এবার একটি স্টার্ট-আপ কোম্পানিতে। সেখানে তিনি তার পছন্দের কাজটি মন দিয়ে করতে পারছেন।
সানোর মতো পেশাজীবনের মধ্যগগনে থাকা কর্মীদের চাহিদাও এখন বাড়ছে।
১৯৯০-এর দশকে যখন অর্থনৈতিক বুদবুদের পতন হয়, তখন জাপান পূর্ণকালীন কর্মীদের একটি প্রজন্মকে হারায়, যারা এখন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের কোঠায়। টোকিওর জেএসি রিক্রুটমেন্টের মুখপাত্র ইয়োকো কোদামা বলেন, এর অর্থ হলো অনেক কোম্পানিরই এখন এমন লোক দরকার যারা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে পারবে এবং ৩৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী।
৪৫ বছর বয়সি কেইসুকে ওচি বলেন, 'আমি একসময় বিশ্বাস করতাম, চাকরি বদলানো উচিত নয়।'
তিনি একটি বড় বিপণন প্রতিষ্ঠানে করতেন। অবসর পর্যন্ত সেখানেই থাকার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ফলে সেখানে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মনে প্রশ্ন ওঠে। এরপর তিনি লক্ষ করেন, তার বয়সি আরও অনেকেই চাকরি ছাড়ছেন।
এখন তিনি একটি আর্থিক পরিষেবা সংস্থায় কাজ করেন।
ওচি বলেন, মহামারি তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাড়ির বাইরে থেকে তিনি কতটা সময় হারিয়েছেন।
'পরিবারের সাথে একসঙ্গে রাতের খাবার খাওয়ার আনন্দ যে কী, তা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি, সেই সময়টা কতটা মূল্যবান।'