ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন ‘বাংকার-বাস্টার’ হামলা হলে কী ছড়াবে বাতাসে?

বলা হয়ে থাকে, ইরানের ভূগর্ভে নির্মিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম একমাত্র প্রচলিত অস্ত্র হচ্ছে মার্কিন 'বাংকার-ব্লাস্টার' বোমা।
সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়লে সংঘাত পরিস্থিতিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আসলেই ইরানের সন্দেহভাজন পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনায় শক্তিশালী এই 'বাংকার-ব্লাস্টার' বোমা ফেলে তাহলে এর পরিণতি কী হবে? এটি কি পারমাণবিক বিকিরণ বা রাসায়নিক ছড়াবে? নাকি আরও ভয়ংকর কিছু?
বিকিরণ ঝুঁকি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই বোমা মাটির নিচের বাংকার ধ্বংস করে ফেললেও, এর ব্যাপক বিকিরণ দূষণের আশঙ্কা কম।
ইরানের 'ফোর্ডো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্লান্ট' নামের এই রহস্যময় স্থাপনা পাহাড়ের গুহায় নির্মিত এবং এখানে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এর ফলে এখানে ইউরেনিয়াম সাধারণত 'ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড' নামক গ্যাস আকারে থাকে।
এ গ্যাস অণু তুলনামূলক বড় ও ভারী হওয়ায় এটি অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম, বলেন আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য পদার্থবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ এমিলি ক্যাফ্রি। তিনি আরও বলেন, হামলার ফলে বিকিরণ বা দূষণ মূলত ওই স্থানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
ওই স্থাপনায় ঠিক কত পরিমাণ ও ধরনের পদার্থ আছে তা প্রকাশিত না হওয়ায় সঠিক ঝুঁকি নিরূপণ করা কঠিন। এই পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়েও পড়ে, তবু এটা কেবল ওই স্থানটির আশেপাশে সীমিত থাকবে এবং যারা সরাসরি ঘটনাস্থলের খুব কাছাকাছি নেই, তাদের জন্য বড় ধরনের কোনো স্বাস্থ্য বা পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত 'ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টস'-এর পারমাণবিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক এডউইন লায়ম্যান জানান, এই ধরনের স্থাপনায় যেসব প্রধান ধরনের ইউরেনিয়াম আইসোটোপ থাকে, সেগুলো 'বিকিরণজনিত ঝুঁকির দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের।'
তিনি বলেন, 'এই পদার্থগুলো যদি পরিবেশে ছড়িয়েও পড়ে, তবু তা কোনো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করবে না। সর্বোচ্চ যা হতে পারে, তা হলো তুলনামূলকভাবে কম মাত্রার দূষণ—একেবারে শূন্য নয়, তবে খুব সম্ভবত ঘটনাস্থলের কাছাকাছি এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।'
তবে একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড গ্যাস যখন বাতাসে থাকা পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তখন এটি 'হাইড্রোফ্লুরিক অ্যাসিড'-এ পরিণত হয়। এডউইন লায়ম্যান বলেন, 'এটি একটি তীব্র বিষাক্ত পদার্থ, যা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে বা প্রাণঘাতীও হতে পারে।'
তবে এই ক্ষেত্রটি যেহেতু ভূগর্ভস্থ গুহায় অবস্থিত এবং 'বাংকার বাস্টার বোমাগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে পাহাড় ধসে পড়ে এই স্থাপনাগুলোকে চাপা দেয়', তাই তিনি মনে করেন 'এই ধ্বংসস্তূপের কারণে কোনো ধরনের পরিবেশগত নিঃসরণ বা ছড়িয়ে পড়া অপেক্ষাকৃত কম হবে, কারণ পাথরের ভারই একে বাধা দেবে।'
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসিও জানান, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর আঘাতের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করছেন।
তিনি জানান, সম্প্রতি একটি হামলায় ইরানের নাতানজ ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্লান্টের ওপরের (ভূ-উপরিস্থিত) অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 'তবে নতানজ সাইটের বাইরে বিকিরণের মাত্রা অপরিবর্তিত রয়েছে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আছে, যা প্রমাণ করে যে এই ঘটনার ফলে জনসাধারণ বা পরিবেশে কোনো বহিঃস্থ রেডিয়োলজিক্যাল প্রভাব পড়েনি', বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, স্থাপনাটির ভেতরে 'রেডিয়েশন ও রাসায়নিক—দুই ধরনের দূষণই দেখা গেছে'।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইডের রাসায়নিক বিষক্রিয়া এবং এটি যখন পানির সংস্পর্শে আসে, তখন যে যৌগগুলো তৈরি হয় তা।
তিনি বলেন, প্রধান বিকিরণ ঝুঁকি আসে যদি কেউ ইউরেনিয়াম শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে বা খেয়ে ফেলে। তবে 'উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে, যেমন শ্বাসযন্ত্র সুরক্ষার যন্ত্র ব্যবহার করে, এই ঝুঁকি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।'