কাশ্মীর নিয়ে অতীতে ভারত-পাকিস্তানের দুটি বড় যুদ্ধ যেভাবে শেষ হয়

কাশ্মীর নিয়ে আবারও সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্মুখীন ভারত ও পাকিস্তান। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে এক জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পরেই নয়াদিল্লি এর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই ঘোষণার পর থেকেই চলছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি– গতরাতে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যে দিয়ে যা আনুষ্ঠানিক লড়াইয়ে গড়াল।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর নিয়ে জন্মলগ্ন থেকেই উত্তেজনা চলে আসছে পাকিস্তান-ভারতের। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বড় দুটি যুদ্ধ লড়েছে তারা। উভয় দেশের বিরোধে ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের মানুষ যেন এক চির অভিশাপের ঘেরাটোপে বন্দি। যুদ্ধ ছাড়াও কাশ্মীর ঘিরে আরও অনেক সংঘাতে জড়িয়েছে তাদের সেনারা।
কাশ্মীরের বিতর্কিত ভূখণ্ড বরাবরই রয়েছে বিশ্বের উত্তেজনার এক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। পারমাণবিক অস্ত্রধর উভয় আঞ্চলিক শক্তিই এ ভূখণ্ডের মালিকানা দাবি করে। যেকারণে এই কাশ্মীর নিয়ে অতীতেও বড় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তারা।
১৯৪৭: প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ
ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক দুটি রাষ্ট্র গঠন হলেও— মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জম্মু অঞ্চলে মুসলমান প্রজাদের বিরুদ্ধে এক গণহত্যা চালায় ডোগরা রাজা হরি সিংয়ের সেনা ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনমতে, এসময় প্রায় ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়। সর্বস্ব হারিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পালিয়ে যায় সীমান্তের ওপার পাকিস্তানে।
১৯৪৭ সালের শেষদিকে সামরিক শক্তির জোরেই সম্পূর্ণ কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। শুরু হয় এক মরণপণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কাশ্মীরের অনেক এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছিল ইসলামাবাদ।
এরপর জাতিসংঘের সমর্থনে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ৭৭০ কিলোমিটার (৪৭৮ মাইল) দীর্ঘ একটি যুদ্ধবিরতি রেখা টানা হয়, যা কার্যত কাশ্মীরকে বিভক্ত করে দেয়। এই সীমারেখা 'লাইন অব কন্ট্রোল' (এলওসি) নামে পরিচিত এবং এ সীমান্ত রেখার দুই পাশেই দুই দেশের সামরিক বাহিনী ব্যাপক যুদ্ধংদেহী প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। নিরাপত্তাও অত্যন্ত কঠোর এই সীমান্তে।
কাশ্মীরের প্রায় ৩৭ শতাংশ পাকিস্তানে ও ৬৩ শতাংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে উভয় দেশই পুরো অঞ্চলটির মালিকানা দাবি করে আসছে।
এই যুদ্ধের পর থেকেই ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে পাকিস্তান। কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে অঞ্চলটিতে বিপুল সামরিক-আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন রাখে দিল্লি। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর সব অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
১৯৬৫: দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধ
কাশ্মীর নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে জড়ায় ভারত-পাকিস্তান।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই বছরের আগস্টে অপারেশন জিব্রালটারের অধীনে ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করে পাকিস্তানী সেনারা। জবাবে পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় পাল্টা হামলা করে ভারত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই যুদ্ধেই বৃহত্তম ট্যাংকের লড়াই হয়, যেখানে উভয়পক্ষের সহস্রাধিক ট্যাংক অংশ নেয়।
এই যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান উভয়পক্ষেই ব্যাপক প্রাণহানি হয়। সেবারই প্রথম কাশ্মীরের বাইরেও ভারত ও পাকিস্তানের অন্যান্য সীমান্তেও এ যুদ্ধের আগুন ছড়ায়।

আকাশপথে লড়াইও নতুন মাত্রা পায় এ যুদ্ধেই। পাকিস্তান ১০৪টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার দাবি করে, আর নিজেদের ১৯টি যুদ্ধবিমান হারানোর কথা স্বীকার করে। অন্যদিকে ভারত ৭৩টি পাকিস্তানি বিমান ধ্বংসের দাবি করে, যার বিপরীতে নিজেদের ৩৫টি যুদ্ধবিমান হারানোর কথা স্বীকার করে।
তবে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের মতে, আকাশপথের যুদ্ধেও দেখা গিয়েছিল অচলাবস্থা। অর্থাৎ, কেউই এক অন্যেকে পরাস্ত করতে পারেনি।
সাত সপ্তাহ পর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যুদ্ধটির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। তবে কোনো চূড়ান্ত ফলাফল ছাড়াই এ সংঘাত শেষ হয়, যেখানে উভয়পক্ষই বিজয় ঘোষণা করে।
বড় দুই যুদ্ধের বাইরেও বিভিন্ন সময় কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কারগিলের সংঘাত।
১৯৯৯: কারগিল সংঘাত
১৯৮৯ সালে ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে নিরাপত্তা বাহিনী ও কাশ্মীরি বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতে হাজার হাজার যোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিক নিহত হয়।
১৯৯৯ সালে পাকিস্তান সমর্থিত বিদ্রোহীরা বিতর্কিত কাশ্মীর সীমান্ত অতিক্রম করে কারগিলের বরফে ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে নেয়। যা আগে মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
১০ সপ্তাহের চেষ্টায় এসব অঞ্চল পুনরায় দখল করে ভারতীয় সেনাবাহিনী, হটিয়ে দেয় অনুপ্রবেশকারীদের। এ সংঘাতের অবসান ঘটলেও উভয় পক্ষের প্রায় ১,০০০ সেনা ও যোদ্ধা এতে প্রাণ হারায়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ থামে।
তবে ২০০১ ও ২০০২ সালে ভারতে একাধিক হামলা হয়, যার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেই দায়ী করতে থাকে দিল্লি। এর জেরে দুই দেশের সীমান্তে আবারও বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করা হয়।
২০০৩ সালে সীমান্তজুড়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। পরের বছর একটি শান্তি চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা কোনো সুস্পষ্ট ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়।