যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল ও গ্রেপ্তারে ক্যাম্পাসজুড়ে আতঙ্ক

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বহু বিদেশি শিক্ষার্থীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টাইমলাইনে বারবার চোখে পড়ছে এক দৃশ্য—সাদা পোশাকে এজেন্টরা হঠাৎ করে এসে শিক্ষার্থীদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ডিটেনশন সেন্টারে।
তাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ নেই। বরং ধারণা করা হচ্ছে, এসব শিক্ষার্থীকে টার্গেট করা হচ্ছে কলেজ ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে। খবর বিবিসির।
ট্রাম্প প্রশাসন একাধিকবার জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের দেওয়া ভিসা 'বিশেষ অধিকার', যেটি যেকোনো সময় বাতিল করা যেতে পারে। তবে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এই দমন অভিযান কেবল কয়েকজন নয়—যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এক হাজারেরও বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী বা সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের ভিসা বাতিল বা আইনি অবস্থান পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে 'ইনসাইড হায়ার এড'-এর একটি ট্র্যাকার।
অনেকেই জানেন না তাদের ভিসা বাতিলের সঠিক কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বিষয়টি জানতে পারছে কেবলমাত্র সরকারি ডেটাবেইস ঘেঁটে, যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভিসা-স্ট্যাটাস আপডেট থাকে।
এমন ঘটনার কারণে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আইভি লিগসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
'আমি পরবর্তী টার্গেট হতে পারি,' বলেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক বিদেশি শিক্ষার্থী, যিনি ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন লেখা লিখেছেন। যেকোনো সময় পুলিশি জেরার মুখোমুখি হলে কী কী অধিকার আছে, তা জানিয়ে একটি কার্ড সব সময় পকেটে রাখছেন তিনি।
টেক্সাসের আরেক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, এখন তিনি নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বাইরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না—এমনকি খাবার কিনতেও না।
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনও হয়েছে যে, বিদেশি গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক—কারণ, গণমাধ্যমে নাম উঠে গেলে তাদের বিপদ আরও বাড়তে পারে।
প্রতিবাদ করলেই ভিসা বাতিল
যদিও ভিসা বাতিলের পিছনে কিছু ক্ষেত্রে অপরাধমূলক রেকর্ড বা ট্রাফিক ভায়োলেশনের মতো ছোটখাটো কারণ দেখানো হচ্ছে, তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও নিজেই বলেছেন, টার্গেট করা শিক্ষার্থীদের 'অনেকেই' ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
হোয়াইট হাউস বলছে, এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এমন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে, যারা ইহুদি শিক্ষার্থীদের জন্য 'অসুরক্ষিত পরিবেশ' তৈরি করেছে এবং হামাসকে সমর্থনের অভিযোগে অভিযুক্ত। মার্কো রুবিও বলেছিলেন, 'এদের যেখানেই পাই, ওদের ভিসা কেড়ে নেই। প্রতিদিন এটা করি।'
নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী সংগঠনগুলো বলছে, এসব আটক ও নির্বাসনের পদক্ষেপ সংবিধানবিরোধী। শিক্ষার্থীরাও হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করে বলছেন, মূলত গাজা যুদ্ধ ও ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে মত প্রকাশ করাতেই তাদের লক্ষ্য করা হচ্ছে।
পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক, টার্গেটের কারণ
জর্জটাউনের পোস্টডক্টরাল ফেলো বদর খান সুরিকে মার্চে ভার্জিনিয়ায় তার বাড়ির সামনে থেকে ধরে নিয়ে যায় ফেডারেল এজেন্টরা। অভিযোগ—তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় 'ইহুদিবিদ্বেষী' মত প্রকাশ করেছেন এবং একজন 'সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর' সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এই 'সন্দেহভাজন' হলেন তার মার্কিন নাগরিক স্ত্রীর বাবা—যিনি একসময় হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন এবং পরে নিহত হন। সুরির আইনজীবীরা বলছেন, তিনি মাত্র কয়েকবার শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাকেও মূলত স্ত্রীর পরিচয় ঘিরে টার্গেট করা হয়েছে।
এর আগে নিউ ইয়র্কে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভ সংগঠক মাহমুদ খালিল। বর্তমানে তিনি লুইজিয়ানার একটি ডিটেনশন সেন্টারে আছেন, প্রত্যর্পণের অপেক্ষায়।
টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের রুমেইসা ওজতুর্ককেও ম্যাসাচুসেটস থেকে আটক করে একই স্থানে নেওয়া হয়েছে। তিনি গাজা নিয়ে একটি সম্পাদকীয় লেখায় সহ-লেখক ছিলেন।
গত সোমবার ভার্মন্টে নাগরিকত্বের সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছেন মোহসেন মাহদাওয়ি, আরেকজন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনিও গ্রিন কার্ডধারী।
'ভিসা কেড়ে নেওয়ার জন্য অতীত ঘেঁটে দেখা হচ্ছে'
জর্জটাউনের সেই শিক্ষার্থী জানাচ্ছেন, তিনি এখন তার মেসেজিং অ্যাপগুলো ক্লিয়ার করে রেখেছেন, ফোনে দ্রুত 'এসওএস মোড' চালু করার পদ্ধতি শিখে নিয়েছেন। এমনকি মা-বাবাকে অনুরোধ করেছেন, যেন তারা তার গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে না আসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীদের নিজেদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক নাদের হাসেমি।
টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনে যুক্ত এক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ওজতুর্কের গ্রেপ্তারের ভিডিও দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিনি। গত রমজানে ইফতারে যাওয়ার পথে তাকে গ্রেপ্তার করে এজেন্টরা। ভিডিওতে তাকে আতঙ্কিত, বিভ্রান্ত দেখা গেছে।
অন্য শিক্ষার্থীরা বলছেন, যারা সম্প্রতি বিদেশ সফর করেছেন, তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকে দূর থেকে অনলাইন ক্লাস করছেন।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মাস্টার্স শিক্ষার্থী জানান, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভয় পাচ্ছি, বাজারে যেতেও ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে হঠাৎ সাদা পোশাকে এজেন্ট এসে ধরে নিয়ে যাবে।'
তিনি আরও জানান, তিনি কখনও আন্দোলনে অংশ নেননি, কিন্তু প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনামূলক মন্তব্য লিখেছিলেন। এখন সেই কথাগুলো তাকে বিপদে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন।
চাপে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ও
ট্রাম্প প্রশাসন শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও চাপে রেখেছে। সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের অ্যান্টিসেমিটিজম (ইহুদিবিরোধী) মোকাবেলায় গঠিত টাস্কফোর্স হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ বিলিয়ন ডলার তহবিল স্থগিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, সরকারের কিছু দাবি মানলে তাদের নিজেদের 'স্বাধীনতা হারাতে হবে'।
ট্রাম্প কর্মকর্তারা হুমকি দিয়েছেন—হার্ভার্ড যদি নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের তথ্য সরবরাহ না করে, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আর ভিসা দেওয়া হবে না।
জর্জটাউনের অধ্যাপক হাসেমি মনে করেন, সরকারের মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিবাদ দমন করা। আর এই দমন-পীড়নের মধ্যে পড়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী।