কর্মসংস্থান কমার তথ্য প্রকাশ করায় অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান সংস্থার প্রধানকে বরখাস্ত করলেন ট্রাম্প

গত তিন মাসে কর্মসংস্থান অনেকটাই ধীর হয়ে গেছে, এমন প্রতিবেদন প্রকাশের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশকারী সরকারি সংস্থা ব্যুরো অভ লেবার স্ট্যাটিস্টিকস-এর (বিএলএস) প্রধানকে প্রধানকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়াই বিএলএসের কমিশনার এরিকা ম্যাকএন্টারফারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কর্মসংস্থান পরিসংখ্যান বিকৃত করার অভিযোগ আনেন।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে ওয়াল স্ট্রিট বড় ধাক্কা খেয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই যখন পূর্বাভাস দিচ্ছেন ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেই সময়ে অর্থনৈতিক তথ্যে হোয়াইট হাউসের হস্তক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে ট্রাম্প এগোনোর পর বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারও টালমাটাল হয়ে পড়েছে।
নতুন শুল্কহার ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি প্রধান সূচকেরই পতন হয়। এর আগে ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারেও ব্যাপক দরপতন দেখা যায়।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের প্রধান মার্কিন অর্থনীতিবিদ রায়ান সুইট বলেন, বিএলএসের কমিশনারকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তটি উদ্বেগজনক।উচ্চমানের অর্থনৈতিক তথ্য ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেসরকারি উৎস থেকে সহজে এর বিকল্প তৈরি করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, 'স্পষ্টতই এটি অত্যন্ত ভুল পদক্ষেপ। তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যদি কোনো প্রশ্ন ওঠে…তবে তা অনেক সমস্যা তৈরি করবে।'
ট্রাম্প তার শুল্ক পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তার দাবি, তার শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন শিল্পকে চাঙা করার পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবে।
তবে চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত নতুন তথ্য ও শুল্কের খরচ বিষয়ে বিভিন্ন কোম্পানির দেওয়া হালনাগাদ তথ্যের পর সেসব পূর্বাভাস উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার ব্যুরো অভ লেবার স্ট্যাটিস্টিকস জানিয়েছে, জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৭৩ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। সংস্থাটি মে ও জুন মাসের চাকরি বৃদ্ধির পূর্ববর্তী হিসাবও ব্যাপকভাবে সংশোধন করে জানিয়েছে, আগের ধারণার চেয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার কম কর্মসংস্থান হয়েছে।
ম্যাকএন্টারফারকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় ট্রাম্প এই সংশোধিত তথ্যের কথাই উল্লেখ করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, 'আমাদের নির্ভুল চাকরির পরিসংখ্যান প্রয়োজন। আমার টিমকে নির্দেশ দিয়েছি বাইডেন মনোনীত এই রাজনৈতিক ব্যক্তিকে অবিলম্বে বরখাস্ত করতে।'
বিএলএস যে শ্রম দপ্তরের অধীনে, তার প্রধান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, নতুন প্রধান পাওয়ার আগপর্যন্ত সংস্থার ডেপুটি কমিশনার উইলিয়াম উইয়াট্রোস্কি ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
শ্রম দপ্তর এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়নি। বিএলএস প্রতি মাসে নতুন তথ্য আসার পর চাকরির পরিসংখ্যান সংশোধন করে, যেখানে সাধারণত কয়েক হাজার পদ যোগ বা বিয়োগ হয়।
এ মাসের পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় থাকলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হালনাগাদ তথ্য অর্থনীতির ধীরগতির অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কেউ কেউ ধারণা করছেন, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আঘাত প্রতিফলিত হয়েছে এ তথ্যে। এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণত সমীক্ষায় দেরিতে সাড়া দেয় এবং শুল্কের কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
ম্যাকএন্টারফার ২০২৩ সালে বিএলএসের প্রধান হিসেবে মনোনীত হওয়ার আগে ২০ বছরেরও বেশি সময় সরকারি চাকরি করেছেন। পরে তিনি মার্কিন সিনেটে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হন।
ডানপন্থি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের অর্থনৈতিক নীতি গবেষণার পরিচালক মাইকেল স্ট্রেইন ম্যাকএন্টারফারের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ম্যাকএন্টারফার 'অত্যন্ত সততার' সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, 'নীতিনির্ধারকদের বোঝা জরুরি যে, সরকারি পরিসংখ্যান নিরপেক্ষ এবং সর্বোচ্চ মানের। এর ওপর সন্দেহ তৈরি করে প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি করছেন।'
পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের সিনিয়র ফেলো জেড কোলকো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, 'বিএলএসের প্রধানকে বরখাস্ত করা মার্কিন অর্থনৈতিক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গোটা পরিসংখ্যান ব্যবস্থার ওপর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইচ্ছাকৃত আঘাত।'
ট্রাম্প তার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছেন, এই পদগুলোতে 'যাদের আমরা বিশ্বাস করতে পারি, তেমন লোকের' থাকা নিশ্চিত করার জন্যই তার এই বিদায় প্রয়োজন ছিল।
শুক্রবার হোয়াইট হাউস ছাড়ার মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের বলেন, 'লোকে এসব সংখ্যা বিশ্বাস করবে কেন? আমি মনে করি, নির্বাচনের আগের মতোই এই সংখ্যাগুলো জাল ছিল—এবং অন্য সময়েও এমন হয়েছে। তাই আমি কী করেছি জানেন? তাকে বরখাস্ত করেছি। আর কী করেছি জানেন? একদম ঠিক কাজটাই করেছি।'
এই তথ্য বিতর্ক এমন সময়ে শুরু হয়েছে, যখন ট্রাম্প বাণিজ্য নীতি ঢেলে সাজাচ্ছেন এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের ওপর ১০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নতুন শুল্ক আরোপ করছেন।