বিশ্বের শীর্ষ ১০ শক্তিশালী পাসপোর্টের তালিকা থেকে প্রথমবারের মতো ছিটকে পড়লো যুক্তরাষ্ট্র; বাংলাদেশ ১০০তম

কোনো দেশের পাসপোর্ট কতটা শক্তিশালী, তা মূলত নির্ভর করে ভিসা ছাড়া কতগুলো দেশে প্রবেশাধিকার আছে তার ওপর। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে সহজেই প্রবেশের এই ক্ষমতা পরিমাপকারী একাধিক সূচকের মধ্যে 'হ্যান্ডলি পাসপোর্ট ইনডেক্স' অন্যতম। এই সূচকের ২০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শীর্ষ ১০-এর তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট।
লন্ডনভিত্তিক বৈশ্বিক নাগরিকত্ব ও রেসিডেন্সি বিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান হ্যান্ডলি অ্যান্ড পার্টনারস ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সূচক তৈরি করে।
শীর্ষে এশিয়ার তিন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ১২তম
বর্তমানে এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে এশিয়ার তিনটি দেশ। সিঙ্গাপুরের পাসপোর্টধারীরা বিশ্বের ১৯৩টি দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন। এরপর আছে দক্ষিণ কোরিয়া, যেখানে ভিসা ছাড়া ১৯০টি দেশে যাওয়া যায়। জাপান ১৮৯টি দেশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
সর্বশেষ ত্রৈমাসিক র্যাঙ্কিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র ১২তম স্থানে নেমে এসেছে, যা মালয়েশিয়ার সঙ্গে একই অবস্থানে। সূচকটিতে ট্র্যাক করা ২২৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ার নাগরিকেরা ১৮০টি দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশাধিকার পান।
হ্যান্ডলির গণনারীতি অনুযায়ী, একই স্কোর পাওয়া একাধিক দেশকে এক স্থানে রাখা হয়, ফলে কার্যত ৩৬টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে আছে।
এদিকে, শক্তিশালী পাসপোর্টের এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে উত্তর কোরিয়া। এই দুটি দেশের নাগরিকেরা বিশ্বের মাত্র ৩৮টি দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট প্রথম স্থানে ছিল। এমনকি চলতি বছরের জুলাইয়েও এটি শীর্ষ ১০-এ নিজেদের স্থান ধরে রেখেছিল।
মার্কিন পাসপোর্টের এমন পতনের পেছনে বেশ কিছু ভিসা নীতির পরিবর্তন কাজ করেছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার বাতিল করে ব্রাজিল।
অন্যদিকে, চীন জার্মানি ও ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের জন্য ভিসা ছাড়ের সুবিধা চালু করলেও যুক্তরাষ্ট্রকে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি।
পাপুয়া নিউগিনি এবং মিয়ানমারও তাদের প্রবেশ নীতি পরিবর্তন করেছে, যা অন্য দেশগুলোর পাসপোর্টের র্যাঙ্কিং বাড়ালেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও দুর্বল করেছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমালিয়ার নতুন ই-ভিসা ব্যবস্থা চালু এবং ভিয়েতনামের ভিসা-মুক্ত তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দেওয়া দেশটির পাসপোর্টের জন্য শেষ ধাক্কা হয়ে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের পতন, চীনের উল্লম্ফন
একসময় ২০১৫ সালে এই সূচকে শীর্ষে থাকা যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টও এবার ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। গত জুলাই মাস থেকে দুই ধাপ নিচে নেমে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম স্থানে ঠাঁই পেয়েছে দেশটি।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের এমন পতনের এই দশকে চীনের পাসপোর্টের শক্তিমত্তা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। ২০১৫ সালে ৯৪তম স্থান থেকে চীন ২০২৫ সালে ৬৪তম স্থানে উঠে এসেছে।
এই সময়ে দেশটির পাসপোর্টধারীরা অতিরিক্ত ৩৭টি গন্তব্যে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার লাভ করেছে। হ্যান্ডলি পাসপোর্ট ইনডেক্সের প্রতিবেদনে চীনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোকে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান উদারতার কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর মধ্যে রাশিয়া, উপসাগরীয় দেশগুলো, দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশের সঙ্গে নতুন ভিসা-মুক্ত চুক্তি উল্লেখযোগ্য।
এই সূচকের অন্যতম সফল দেশ হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। গত এক দশকে দেশটি ৪২তম স্থান থেকে ৮ নম্বরে উঠে এসে ৩৪ ধাপ উন্নতি করেছে।
তলানিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো
অন্যদিকে, তালিকার একদম তলানিতে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। ১০৬তম স্থানে থাকা আফগান পাসপোর্টধারীরা মাত্র ২৪টি দেশে ভিসা ছাড়া যেতে পারেন, যা চলতি বছরের শুরুতেও দুটি বেশি ছিল।
১০৫তম স্থানে সিরিয়া (২৬টি গন্তব্যে প্রবেশাধিকার) এবং ১০৪তম স্থানে ইরাক (২৯টি গন্তব্যে প্রবেশাধিকার) রয়েছে। শীর্ষ ও তলানিতে থাকা পাসপোর্টের মধ্যে গতিশীলতার পার্থক্য বিশাল, প্রায় ১৬৯টি গন্তব্যের ফারাক।
এই তালিকাটি ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন পাসপোর্টের প্রবেশাধিকার অনুযায়ী র্যাঙ্কিং তৈরি করে। আর্টন ক্যাপিটালের পাসপোর্ট ইনডেক্স ১৯৩টি জাতিসংঘের সদস্য দেশ এবং ছয়টি অঞ্চল—তাইওয়ান, ম্যাকাও, হংকং, কসোভো, ফিলিস্তিনি অঞ্চল ও ভ্যাটিকানের পাসপোর্ট বিবেচনা করে।
আর্টনের গ্লোবাল পাসপোর্ট পাওয়ার র্যাঙ্ক ২০২৫ অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৭৯ স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে। ১৭৫ স্কোর নিয়ে সিঙ্গাপুর ও স্পেন যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছে।
২০২৫ সালের সবচেয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট (ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকারের ভিত্তিতে):
১. সিঙ্গাপুর (১৯৩টি গন্তব্য)
২. দক্ষিণ কোরিয়া (১৯০)
৩. জাপান (১৮৯)
৪. জার্মানি, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, স্পেন, সুইজারল্যান্ড (১৮৮)
৫. অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস (১৮৭)
৬. গ্রীস, হাঙ্গেরি, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, সুইডেন (১৮৬)
৭. অস্ট্রেলিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, মাল্টা, পোল্যান্ড (১৮৫)
৮. ক্রোয়েশিয়া, এস্তোনিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য (১৮৪)
৯. কানাডা (১৮৩)
১০. লাটভিয়া, লিচেনস্টাইন (১৮২)
১১. আইসল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া (১৮১)
১২. যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া (১৮০)