স্থানীয়দের দানে ৭৬ কিলোমিটারের ভুলুয়ার খনন শুরু; ২০ বছর পর নদীতে এল স্রোত

লম্বায় ৭৬ কিলোমিটার আর ১০০ মিটরের বেশি প্রস্থের ভুলুয়া নদীটি লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী। কিন্তু গত প্রায় ২০ বছর যাবত এ নদীতে কোন স্রোত নেই। বাঁধ দিয়ে, দখল এবং মাছ ধরার জাল পেতে নদী দখলে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
পানিপ্রবাহ না থাকায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে তৈরি হয় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। হাজার হাজার একর জমিতে ফসল ফলাতে পারে না কৃষক। যুগ যুগ ধরে প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন করেও ফল মেলেনি। তাই এবার নিজেদের সামান্য দান অনুদানে ৭৬ কিলোমিটার ভুলুয়া নদী খনন শুরু করেছে স্থানীয়রা।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের আজাদনগর স্টীল ব্রিজ এলাকা থেকে খনন কার্যক্রম শুরু করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষক মুফতি নুরুল্লাহ খালেদ, মুফতি মো. শরীফুল ইসলাম, মাওলানা কামাল উদ্দিন তাহেরি, কৃষক মিজানুর রহমান পিংকু, সমাজসেবক জাহাঙ্গীর আলম ও সোহেল ভুইঁয়ার উদ্যোগে গত ২৪ জুলাই এ কার্যক্রম শুরু করা হয়।
শনিবার (২ আগস্ট) লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের আজাদনগর স্টিল ব্রিজ এলাকা গিয়ে দেখা গেছে ২টি স্কেভেটর মেশিন ভুলুয়া নদী থেকে মাটি কেটে ওপরে তোলা হচ্ছে। এসময় নদীতে স্রোত দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহাব উদ্দিন বলেন, 'গত প্রায় ২০ বছর পর এ প্রথম ভুলুয়া নদীতে স্রোত দেখলাম। এতে খুবই খুশি লাগছে। এর আগে সর্বশেষ ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে ভুলুয়ায় স্রোত ছিল।'

এসময় ভুলুয়া নদী খননের একজন উদ্যোক্তা ও মাদ্রাসা শিক্ষক মুফতি শরীফুল ইসলাম জানান, ২ আগস্ট পর্যন্ত ৯দিনে প্রায় ২ কিলোমিটার নদীর এক দিকে খনন করা হয়। এতেই নদীতে তীব্র স্রোত তৈরি হয়েছে।
তিনি আরো জানান, যদি এ বর্ষায় মাত্র ৪ কিলোমিটার নদী খনন করা যায়, তাতে এ বছর আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। খনন কাজে স্থানীয় মানুষ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে। বিভিন্ন এলাকাবাসী তাদের স্থানীয় বাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা থেকে দান অনুদান তুলে নদী খননে সহায়তা করছে। তবে অনেক টাকার প্রয়োজন বলে জানান, মুফতি শরীফুল ইসলাম।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১০০ মিটারের বেশি প্রস্থের ভুলুয়া নদী দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা এবং নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলা ও সুবর্ণচর উপজেলা হয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। এসময় এ নদী লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার ২০টি ইউনিয়নকে সংযুক্ত করেছে।
নদীটি এ অঞ্চলের কৃষি , মৎস্য আহরণ ও অন্যান্য কাজে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বর্তমানে তা এলাকাবাসীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দখলদারির কারণে পলি জমে মরে গেছে। সামান্য বৃষ্টিপাত হলেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
কৃষক মিজানুর রহমান পিংকু বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাস মারাত্মক জলাবদ্ধতায় পড়ে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। প্রায় এক লাখ একর জমিতে কোনো ফসল হয়নি। বারবার লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানো হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড ও লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ।
মাদ্রাসার শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অল্প খনেনই নদীতে স্রোত তৈরি হয়েছে। এরকম স্রোত থাকলে আগামী একসপ্তাহের মধ্যে ভুলুয়ার পানি কমে যাবে। নদী খনন করা হলে জলাবদ্ধতা কমবে, জমিতে আমন ফসল ফলানো যাবে।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, চলতি বর্ষা শুরুর আগেই ভুলুয়া নদী খনন করতে মানববন্ধন শেষে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভুলুয়া নদী থেকে সকল অবৈধ বাঁধা অপসারণ করে নদীটি খনন করে রামগতি-কমলনগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্টে একটি রিটপিটিশন দাখিল করেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহাব উদ্দিন, রাকিব হোসেন ও মিজান বলেন, এত কিছুর পরেও প্রশাসন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ভুলুয়া নদীতে অন্তত জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জাল পেতে কিংবা পানি আটকিয়ে মাছ ধরা বন্ধের জন্য প্রশাসন লিখিত নোটিশ দিতে পারে। এতে তো কোন টাকা পয়সা খরচ হবে না। প্রশাসন সেটাও করেনি।
মুফতি শরীফুল ইসলাম বলেন, 'সরকারের আশায় পড়ে থাকলে এ অঞ্চলটি শেষ হয়ে যাবে। তাই এবার আমরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছি। তবে আমরা প্রত্যাশা করবো পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলা প্রশাসক আমাদেরকে যন্ত্রপাতি ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করবে।'
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, 'নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ভুলুয়া নদী খননের জন্য যৌথভাবে একটি সমীক্ষা চলছে। আশা করি খুব শীঘ্রই কাজ হবে। অন্যদিকে এলাকাবাসীর নিজস্ব উদ্যোগে নদী খননের কথা আমাদেরকে জানিয়েছে। আমরাও তাদেরকে বলেছি আমরা যতটুকু পারি সাধ্যমতো সহযোগিতা করবো।' সব কিছুর আগে মানুষ ও ফসল বাঁচতে হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।