ট্রাম্পের ২৫% শুল্ক, ‘মৃত অর্থনীতি’ বলায় ক্ষোভে ফুঁসছে ভারতীয়রা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হঠাৎ করেই ভারতের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় আক্রমণ এবং ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের ঘটনায় চমকে উঠেছে ভারতের ব্যবসায়ী মহল, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণ।
এই সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম 'ট্রুথ সোশাল'-এ ভারতকে "সবচেয়ে বিরক্তিকর ও কঠোর বাণিজ্য বাধা" প্রয়োগকারী দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ও জ্বালানি কেনার জন্য ভারতকে আর্থিক জরিমানাও গুণতে হতে পারে। তার একদিন না যেতেই তিনি আবার বলেন, "আমার এতে কিছু যায় আসে না, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করে। তারা চাইলে একসাথে তাদের মৃত অর্থনীতিগুলো নিয়ে ডুবতে পারে।"
এরপর শুক্রবার থেকেই ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কার্যকর হয়ে যায়। যদিও ভারতই একমাত্র দেশ নয় যাকে ট্রাম্পের 'শুল্ক-আঘাতে' পড়তে হলো, তবুও সামগ্রিকভাবে ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীরা বড় ধাক্কার সম্মুখীন হলেন।
এই বাস্তবতায়, যখন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পাল্টা পদক্ষেপ বিবেচনা করছিলেন এবং ব্যবসায়ীরা সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে ব্যস্ত, তখন দেশটির অনলাইন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা ট্রাম্পের মন্তব্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এপ্রসঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রকাশ্য অবমাননার পরেও কেন ভারত সরকার কার্যকর কোনো প্রতিবাদ জানাচ্ছে না।
মুম্বাইয়ের চয়েস ওয়েলথের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট অক্ষত গার্গ বলেন, "হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক উত্তেজনা থেকে সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এটি কোনো কাঠামোগত বাণিজ্য নীতি মনে হচ্ছে না, বরং সরাসরি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ।"
তাঁর মতে, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আরও বিতর্কিত হয়ে ওঠে যখন একইদিনে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বাণিজ্য সুবিধা চুক্তি প্রকাশ করে, যার শর্ত ভারতীয়দের চেয়ে অনুকূল।
শুল্ক আরোপের তালিকায় দেখা যায়, ভারতের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলেও, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের উপর এই হার ২০ শতাংশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ শুল্ক দেওয়া হয়েছে।
তামিলনাড়ুর তিরুপুরের পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এসএনকিউএস ইন্টারন্যাশনালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভি. ইলাঙ্গোভান বলেন, "সবচেয়ে বড় আঘাত হলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে ভালো সুবিধা পেল। অথচ আমরাও ১৫-২০ শতাংশ শুল্কের প্রত্যাশা করছিলাম।"
ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে 'বন্ধু' বলে টুইট করেছিলেন ট্রাম্প, দুই দেশের সম্পর্ককে 'বিশেষ' বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি। সেই বিশ্বাস নিয়েই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্য তথা শুল্ক আলোচনায় অংশ নিয়েছিল, এবং অগ্রাধিকারমূলক চুক্তির আশা করেছিল।
কিন্তু হঠাৎ করে শুল্ক আরোপ এবং রাশিয়া ও ভারতকে জড়িয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য— ভারতীয়দের এই বিশ্বাসের ভীত নড়বড়ে করে দিয়েছে।
কী ভাবছে দিল্লি?
ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি আরও বাড়িয়ে হোয়াইট হাউসকে সন্তুষ্ট করার উপায় খুঁজছে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। দেশটির একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসাবান্ধব চুক্তির আশা করছে।
জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক সব্যসাচী রায় বলেন, "আমরা উদ্বিগ্ন, কিন্তু আতঙ্কিত না। আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক সুবিধার একটি চুক্তি করা সম্ভব।"
দ্য কোয়ান্টাম হাবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রোহিত কুমার বলেন, "এই ঘোষণাটি হঠাৎ মনে হলেও—এটি সম্ভবত আলোচনার চাপ সৃষ্টির একটি কৌশল।"
দিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর বিবেক মিশ্র বলেন, "এই মুহূর্তে এটি ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ওপর ঝড় তুলেছে, তবে এটা অতিক্রম করা সম্ভব।"
বুধবার ভারতে যখন ট্রাম্প ঘোষিত ২৫ শতাংশ শুল্কের খবর প্রকাশিত হয়, তখন কানোদিয়া গ্লোবালের পরিচালক আশীষ কানোদিয়া "অত্যন্ত বিচলিত" হয়ে পড়েন। হোম ফ্যাব্রিকস থেকে শুরু করে খেলনা রপ্তানি করা তার প্রতিষ্ঠানের ৪০ শতাংশের বেশি রাজস্ব আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইতোমধ্যেই তার দুইজন বড় মার্কিন ক্রেতা শুল্কের ক্ষতি পোষাতে "মূল্যছাড় চেয়েছে" বলে ব্লুমবার্গকে জানান তিনি।
কানোদিয়া বলেন, "পরবর্তী ছয় মাস আমাদের সবার জন্য কঠিন হতে যাচ্ছে"। তার মতে, এতে মুনাফার হার কমবে, এবং যদি এই চাপ মাসের পর মাস চলতে থাকে, তাহলে শ্রমিক ছাঁটাই করতেও বাধ্য হতে পারেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, যেখানে ২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ১২৯.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।