ব্লেয়ারকে ভরসা করেন ট্রাম্প, বাকিরা করেন না—গাজার প্রশাসক হলে তিনি কি সফল হবেন?
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক দশকেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন স্যার টনি ব্লেয়ার। সমঝোতার রাজনীতিতে তিনি ছিলেন দক্ষ, প্রচলিত ডান-বাম দ্বন্দ্ব এড়িয়ে কেন্দ্রীয় অবস্থান তৈরি করতে পারদর্শী ছিলেন। এজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনে তাকে বলা হতো 'টেফলন টনি'।
এখন প্রশ্ন উঠেছে— যদি গাজায় যুদ্ধ থামে এবং শান্তি ফিরে আসে, আর অবশিষ্ট ভূখণ্ড পরিচালনার জন্য তাকে আহ্বান জানানো হয়, তবে কি এই অভিজ্ঞ রাজনীতিক সব পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখতে পারবেন? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— তিনি কি বন্দুকের শব্দ চিরতরে থামাতে সক্ষম হবেন?
যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থায় ব্লেয়ারের সম্ভাব্য ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনায় যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পরিচালনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক অন্তর্বর্তী সংস্থা গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। এই তথাকথিত 'বোর্ড অব পিস'-এর নেতৃত্ব দেবেন ট্রাম্প নিজেই। আর সদস্য হবেন ৭২ বছর বয়সী ব্লেয়ার। সাংবাদিকদের কাছে ট্রাম্প ব্লেয়ারের প্রশংসা করে বলেছেন, 'ভালো মানুষ, খুব ভালো মানুষ।'
এমন প্রস্তাব কারও কাছে বিস্ময়কর নয়। কয়েক মাস ধরে গাজা শান্তি প্রস্তাব প্রণয়নে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছেন এই সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি কাজ করছেন ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা রন ডারমারের সঙ্গে।
গত আগস্টে ব্লেয়ার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা উপত্যকার জন্য কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। এর এক মাস আগে তিনি একই স্থানে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গেও বৈঠক করেছিলেন।
এক বিবৃতিতে ব্লেয়ার ট্রাম্পের পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি একে 'দুঃসাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত' আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি হলো 'দুই বছরের যুদ্ধ, দুর্দশা ও দুঃখ-কষ্টের অবসানের সর্বোত্তম সুযোগ'। ব্লেয়ারের মতে, এই প্রস্তাব শুধু ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তির পথ উন্মুক্ত করবে না, বরং 'চরমপন্থার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক জোট গড়ে তোলার' এবং জাতির মধ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠারও সুযোগ সৃষ্টি করবে। মূল কথা, এটাই সেই লক্ষ্য— যার জন্য তিনি দীর্ঘ দশক ধরে বিভিন্ন ভূমিকায় কাজ করে আসছেন।
১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন ব্লেয়ার। সে সময় তিনি ক্লিনটন প্রশাসনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন। ২০০৭ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়ার দিনই তাকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তথাকথিত 'কোয়ার্টেট'-এ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ একত্রে শান্তি প্রচেষ্টা সমন্বয়ের জন্য কাজ করছিল। তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত।
ব্লেয়ারের সমর্থকদের দাবি, কোয়ার্টেটে তার দায়িত্ব মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্রিক ছিল; রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে তাকে দূরে রাখা হয়েছিল। পরে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডসহ তার অন্যান্য উদ্যোগ— বিশেষ করে 'টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ' তাকে এখনো এই অঞ্চলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রেখেছে।
দীর্ঘ দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকা এই অভিজ্ঞতা, নেটওয়ার্ক এবং ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আস্থা তাকে অন্যরকম করে তুলেছে। কূটনীতিকদের মতে, এ কারণেই তিনি এই ভূমিকায় একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
মধ্যপ্রাচ্য অ্যাসোসিয়েশনের মহাপরিচালক নিক হপটন বলেন, '২৪ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্ত থাকার কারণে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমনকি পশ্চিমা কোনো নেতা এই দায়িত্ব নিতে পারবে বলে কল্পনা করা যায় না।' তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু সফলতা নিশ্চিত করতে হলে তাকে ট্রাম্পের আস্থা অর্জন করতে হবে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর দ্বারা প্রভাবিত নয় বলে ধারণা দিতে হবে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আস্থা অর্জনও জরুরি।'
তবে, এক বড় কিন্তু রয়েছে—টনি এই ভূমিকায় অনেক 'ব্যাগেজ [অতীতের বিতর্ক বা সমালোচনা]' নিয়ে আসবেন। কিছু মানুষের কাছে তিনি বিতর্কিত, আবার কেউ কেউ তাকে আরও খারাপ হিসেবে দেখেন।
ইরাক যুদ্ধে ব্লেয়ারের ভূমিকা এখনও বিতর্কিত
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণে অংশগ্রহণের জন্য তিনি আজও বিতর্কিত। দেশটিতে গণ-বিধ্বংসী মরণাস্ত্র আছে— এমন ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অভিযান চালানো নিয়ে তার বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ রয়েছে, তেমনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধেরও অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানিজ সরাসরি বলেছেন, 'টনি ব্লেয়ার? না। ফিলিস্তিন থেকে দূরে থাকুন। হয়তো দ্য হেগে দেখা হবে?' তিনি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান স্যার সাইমন ফ্রেজার বলেন, ব্লেয়ার ফিলিস্তিনি ইস্যুতে প্রকৃত আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং ওয়াশিংটন, ইসরায়েল ও গালফ অঞ্চলে বিশ্বাসযোগ্য। তবে তিনি যোগ করেন, 'আরব জনতা ইরাক ভুলে যায়নি।'
তিনি বলেন, 'গাজার ভবিষ্যৎ পরিচালনার জন্য বড় একটি দল দরকার, যাতে এটি শুধু আমেরিকা বা ব্রিটেনের উদ্যোগের মতো না মনে হয়।' তবে হামাসকে এই প্রস্তাবের প্রতি আগ্রহী মনে হয়নি। দলের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য হুসাম বাদরান বলেছেন, গাজা পরিচালনার বদলে ইরাক আক্রমণের জন্য ব্লেয়ারের বিচার হওয়া উচিত। তিনি বলেন, 'যে কোনো পরিকল্পনা যা ব্লেয়ারের সঙ্গে জড়িত, তা শুভ সংকেত নয়।'
কিছু ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য পর্যবেক্ষকও মনে করেন, ব্লেয়ার সবসময় ইসরায়েল ও মার্কিন অবস্থানের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সাবেক আন্তর্জাতিক শান্তি আলোচক নোমি বার-ইয়াকোভ বলেন, 'আমি মনে করি না ফিলিস্তিনিরা তাকে বিশ্বাস করে। তারা তাকে কোয়ার্টেটের বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্বকালীন সময়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছে।'
আকর্ষণীয় প্রশ্ন হলো, কেন ব্লেয়ার এখনও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ সমাপ্তির প্রচেষ্টায় যুক্ত হতে চান। দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে তিনি শান্তির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেখেন, বিশেষ করে 'গুড ফ্রাইডে' চুক্তি সফলভাবে আলোচনায় এনে উত্তর আয়ারল্যান্ডে সংঘাত কমানোর পর।
তবে ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে ক্ষমতার দিনগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তিনি কখনও মেনে নেননি যে কেউ তার দৃষ্টিভঙ্গি মানতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি তাকে ব্যথিত করত। এই দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য তার কাছে একটি 'অসমাপ্ত কাজ' হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়েস স্ট্রিটিং পিএ মিডিয়াকে বলেছেন, ইরাক যুদ্ধের কারণে ব্লেয়ারের ভূমিকা নিয়ে 'প্রশ্ন উঠতে পারে', তবে তিনি উত্তর আয়ারল্যান্ডে স্থায়ী শান্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার 'অবিশ্বাস্য অবদান'-এর কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, 'যদি তিনি সেই দক্ষতা ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের সমাধানে প্রয়োগ করতে পারেন এবং ইসরায়েলি, ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সমর্থন পান, তবে তা আরও ভালো।'
তবে বাস্তবে ব্লেয়ারের ভূমিকাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই শান্তি পরিকল্পনা সফল এবং স্থায়ী হলে তিনি কাজ পাবেন, কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই। বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো উভয় পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান মতবিরোধ এবং হোয়াইট হাউসের কাঠামোতে এখনও সমাধান না হওয়া বিষয়গুলো।
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য প্রোগ্রামের পরিচালক সানম ভাকিল বলেন, 'ব্লেয়ার এবং তার ইরাক হস্তক্ষেপের ইতিহাসে নজর দেওয়ার ফলে এই শান্তি কাঠামোর প্রকৃত চ্যালেঞ্জগুলো ঢেকে যায়। এতে বিস্তারিত, সময়সীমা এবং বাস্তবায়নযোগ্য বিষয় নেই, এবং এখনও ফিলিস্তিনি বা ইসরায়েলি স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি কাগজে থাকা ২০ দফার বাইরে যথেষ্ট কাজ না করা হয়, তবে এটি হবে আরও এক ধরনের বাহ্যিক কূটনীতি, যা কাঠামোগত অন্যায়কে শক্তিশালী করবে এবং ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসন থেকে বঞ্চিত করবে।'
যদি তার কাজ হয় কেবল গালফের নেতাদের এবং হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সমন্বয় করা, তবে তা আলাদা বিষয়। কিন্তু যদি তাকে কার্যত গাজা শাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়— পুনর্গঠন, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তদারকি করার দায়িত্ব তার ওপর আসে— তাহলে বিষয়টি পুরো ভিন্ন। একজন কূটনীতিক লিখেছেন, 'ভাইসরয় ব্লেয়ার? তা কখনো কাজ করবে না।'
