এআই ডল ট্রেন্ডে ঝুঁকছে সবাই, কিন্তু বাড়াছে উদ্বেগ―সেগুলো কী?

সোশ্যালি মিডিয়ায় স্ক্রল করতে গিয়ে আপনি হয়ত নতুন ট্রেন্ড খেয়াল করবেন। বন্ধুবান্ধব সবাইকেই দেখবেন, হঠাৎ করেই তারা ক্ষুদ্রাকৃতির নিজেদের ছবি শেয়ার করছেন।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি বলছে, এটি একটি নতুন ট্রেন্ড। মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) টুল যেমন―চ্যাটজিপিটি বা কোপাইলট―ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষুদ্রাকৃতির ছবি তৈরি করছেন। ছবিগুলো অনেকটা ছোট্ট পকেট সাইজের পুতুলের মতো।
ট্রেন্ডটি ইতোমধ্যে অনলাইনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ইনফ্লুয়েন্সাররা এ ট্রেন্ডে অংশ নিচ্ছেন।
তবে অনেকেই আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ মনে হওয়া এ ট্রেন্ড থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের মতে, মানুষের মধ্যে যেন 'ফিয়ার অফ মিসিং আউট' বা নতুন কিছুতে অংশ না নেওয়ার আক্ষেপ না তৈরি হয়। কারণ এআই টুলের অত্যাধিক ব্যবহার অনেক সময় প্রযুক্তির বিদ্যুৎ ও ডেটা ব্যবহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে বাধাগ্রস্ত করে।
এআই ডল জেনারেটর কীভাবে কাজ করে?
কথাটি শুনতে জটিল মনে হলেও, প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ।
মানুষ সাধারণত চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুলে নিজের একটি ছবি আপলোড করে এবং চূড়ান্ত ছবিটি কেমন হবে দেখতে তা লিখে নির্দেশনা দেয়।
এই নির্দেশনাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর মাধ্যমে এআই টুলটি বুঝতে পারে, তাকে ঠিক কী তৈরি করতে হবে—যেমন, ওই ব্যক্তির পাশে কী কী বস্তু থাকবে, কিংবা সেই মিনি-রূপটি কী ধরনের প্যাকেজিংয়ে থাকবে। এতে এমনকি জনপ্রিয় খেলনার (যেমন বার্বি) বক্সের ডিজাইন ও ফন্টও অনুকরণ করার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে।
অনেকে এরপর আরও এক ধাপ এগিয়ে তা ব্যক্তিগতভাবে সাজিয়ে নেন—নিজের নাম, পেশা বা পোশাকের ধরন অনুযায়ী।
তবে এটি সব সময় ঠিকভাবে কাজ করে না। অনেকেই এআইয়ের তৈরি মজার ভুল ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। বেশিরভাগ ছবিতে তারা অভিযোগ করেছেন অ্যাকশন ডলগুলো একেবারেই তাদের মতো দেখাচ্ছিল না।
অন্যান্য জেনারেটিভ এআই টুলের মতো, ইমেজ জেনারেটরগুলোও নির্দেশনা অনুসারে কিছু একটা বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। নির্দেশনা ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে মানুষটি কেমন দেখতে হওয়া উচিত সে অনুযায়ী ছবি বানিয়ে দেয় এআই।
এটি এখন আর শুধু সাধারণ মানুষের ব্যবহারে মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই ট্রেন্ড এখন অনেক নামিদামি ব্র্যান্ডের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রসাধনী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ম্যারিও বাদেস্কু থেকে শুরু করে রয়েল মেইলের মতো প্রতিষ্ঠানও এতে অংশ নিচ্ছে।
এর মূল আকর্ষণ কী?
বিভিন্ন ট্রেন্ড আসে এবং তা চলেও যায়। মানুষ তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এসবে অংশ নিতে বাধ্য হয়।
ই-মার্কেটারের প্রধান সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষক জেসমিন এনবার্গ বলেন, "জেনারেটিভ এআই মানুষের জন্য ট্রেন্ডে অংশ নেওয়াকে আরও সহজ এবং গতিশীল করে তুলেছে।"
তিনি বলেন, "প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে অনলাইন কনটেন্ট তৈরি করা এখন খুব দ্রুত এবং সহজ করে তুলেছে। যদিও অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী এসবের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়েন।"
তবে তিনি বিশ্বাস করেন, এআই টুলগুলোর কারণে ট্রেন্ডগুলো আমাদের ফিডে আরও নিয়মিতভাবে দেখা যাবে। কারণ প্রযুক্তিটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।
তবে সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়গুলো কী?
মজার আকৃতির কারণে মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ এ ট্রেন্ডের পরিবেশগত প্রভাবের কারণে এর সমালোচনা করতে শুরু করেছে।
কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি লন্ডনের অধ্যাপক জিনা নেফ বিবিসিকে বলেন, চ্যাটজিপিটির কারণে অনেক বিদ্যুৎ খরচ হয়। এসব তৈরিতে যে ডেটা সেন্টার ব্যবহৃত হয় সেগুলো বছরে ১১৭টি দেশের চেয়েও বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে।
টেকরাডারের ইউএস এডিটর ল্যান্স ইউলানফ তার ট্রেন্ড বিষয়ক এক আর্টিকেলে লিখেছেন, "আমার বাড়িতে একটি মজার কথা প্রচলিত আছে, আমরা যতবার এআই ব্যবহার করে একটি মিম তৈরি করি ততবার একটি গাছ মরে যায়।"
তিনি আরও বলেন, "কথাটি হয়ত অতিরঞ্জিত। তবে এটা বলা নিরাপদ যে এআই কনটেন্ট তৈরিতেও কিছু জিনিস খরচ হয়। আমাদের বিষয়টি নিয়ে হয়ত ভাবতে হবে ও একে ভিন্ন ভাবে ব্যবহারের বিকল্প নিয়ে ভাবতে হবে।"
অনেকে এর বিষয়ে আরও অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যেমন―ছবি তৈরিতে কপিরাই করা ডেটা ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য কোনো খরচ দেওয়া হচ্ছে না।
জিনা নেফ বলেন, "চ্যাটজিপিটি বার্বি আমাদের তিনটি জিনিসের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। সেটা হলো―গোপনীয়তা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ।
তিনি আরও বলেন, "এর ব্যবহার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগতে পারে। কিন্তু এ সিস্টেমগুলো ব্র্যান্ড ও চরিত্রগুলোকে একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলছে এবং এলোমেলো কিছু তৈরি করছে। কিন্তু এর জন্য কোনো দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে না।"
ক্রিয়েটিভ এজেন্সি এমএসএল ইউকে ও পিআর-এর ইনফ্লুয়েন্সার ও সোশ্যাল ডিরেক্টর জো ব্রোমিলো প্রশ্ন রাখেন, একটি সুন্দর ও মজার ফলাফল কি আসলেই এর যোগ্য?
তিনি বলেন, "যদি আমরা সত্যিই এটি ব্যবহার করতে চাই তাহলে এটি সচেতনভাবে ব্যবহারের জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা উচিত।"
এআই ডল ট্রেন্ড-এর পরীক্ষা
ছবিটি তৈরির জন্য অনলাইনে প্রম্পট এর তালিকা খুঁজতে থাকেন এর প্রতিবেদক।
এই প্রম্পটের সঙ্গে সঙ্গে নিজের একটি সেলফিও তুলতে হবে এবং খুব স্পষ্টভাবে বলতে হবে যে আপনি কী চান, যেমন কোন এক্সেসরিজগুলো আপনি চান এবং বক্সটির রঙ কী হবে।
প্রতিবেদন যখন তার নিজের পেশার শিরোনাম দেওয়ার চেষ্টা করেন সেটি বাতিল হয়ে যায়। কারণ তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠানের নাম বিবিসি নিউজ দিলে সে কন্টেন্ট পলিসি লঙ্ঘন করছে বলে বলা হয়। অর্থাৎ বিবিসির আউটপুটের জন্য চ্যাটজিপিটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদক জানান, প্রথমবার ছবি পেলে আপনি সম্ভবত আর এটি ঠিক করতে চাইবেন না। তার পাওয়া প্রথম ছবিটি খুবই কার্টুন-সদৃশ ছিল।
তিনি আরও জানান, পরবর্তী প্রচেষ্টায় তৈরি করা ছবিগুলোতে তাকে আরও বয়স্ক দেখানো হয়েছিল। তারপর অনেক বেশি শিশুতোষ এবং শেষপর্যন্ত আমি নিজের চোখের রঙ ব্যবহার করার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রচেষ্টা বাদ দিয়েছিলাম (আমার চোখের রঙ হ্যাজেল এবং সবুজের মিশ্রণ)।
ছবির সংস্করণ সম্পর্কে তিনি জানান, প্রত্যেকটি সংস্করণ তৈরি করতে কয়েকটি মিনিট সময় লেগেছিল এবং মোটামুটি প্রক্রিয়াটি আমার পছন্দের চেয়ে ধীর ছিল, সম্ভবত এর জনপ্রিয়তার কারণে।
তখন তিনি ভাবতে থাকেন আসলে একটি অস্থায়ী ট্রেন্ডের জন্য এটি অনেক কাজ। তিনি বলেন, "এটি নিখুঁত নয়—আমার ডলটি যে প্যাকেজিংয়ের নিচে থাকা উচিত, তা থেকে অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছে।"
কিন্তু বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এ ছবি তৈরি করতে কোনো একটি ডেটা সেন্টারে শক্তিশালী কম্পিউটার সার্ভার অ্যাকশন ফিগার জোই তৈরি করতে পরিশ্রম করছে।
তাই নিশ্চিতভাবেই তাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মত দেন প্রতিবেদক।