ট্রাম্প পিছু হটেছেন ঠিকই, কিন্তু লড়াই এখনও অনেক বাকি

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ঘনিষ্ঠদের পক্ষ থেকে ধরে একরকম নায়কোচিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে—এই বার্তাটি ছড়ানোর জন্য যে, গত সাত দিনের ঘটনাপ্রবাহ আসলে চরম বিশৃঙ্খলা ছিল না।
তাদের দবি অনুযায়ী, ট্রাম্প এমন দাবা খেলায় নেমেছেন যেখানে চীন এখন কোণঠাসা। মার্কিন বাজারে কঠোর শুল্কারোপে চীনের অর্থনীতি বড় ধাক্কার মুখে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ট্রাম্প যদিও পরে কিছুটা পিছু হটেছেন, তবু যুক্তরাষ্ট্র এক বিশাল রক্ষণশীল শুল্কপ্রাচীর তুলে ফেলেছে। ১৯৩০-এর দশকের পর দেশটিকে আর এত বড় শুল্কপ্রাচীর তুলতে দেখা যায়নি।
এখন বিশ্বের সব দেশের ওপরই কার্যত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে—কোন দেশ যুক্তরাষ্ট্রে কতটা রপ্তানি করছে, তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। যেমন: যুক্তরাজ্য কিংবা অস্ট্রেলিয়া যদি যুক্তরাষ্ট্রে কম বিক্রি করে, তা-ও তারা ছাড় পাচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে যুক্তরাজ্যের আর কোনো তফাত রইল না। এর মধ্যে ইইউয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, এবং জোটটি পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
সামনে কী ঘটবে, তা নিয়ে সারা দুনিয়া এখন উৎকণ্ঠিত। একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প কি যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিপণ্য ওষুধের ওপরও শুল্ক চাপাতে যাচ্ছেন?
আরেকটি বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে 'চীনে তৈরি' পণ্য নিয়ে আসা প্রতিটি কার্গো জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রে ভিড়লেই সেগুলোর ওপর কয়েক মিলিয়ন ডলারের বন্দর কর আরোপ করা নিয়ে। শুক্রবার থেকে এই কর কার্যকর হতে যাচ্ছে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি বাণিজ্যিক নৌবহরই এই করের আওতায় পড়বে।
ট্রাম্প যদিও বাড়তি শুল্ক আরোপ আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন, তবু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রুট পরিবর্তনের ধকল সহ্য করার মতো স্থিতিশীলতা এখনও নেই কোনো কোম্পানির।
চীনের ধাক্কা
তবে এখনকার মূল ইস্যু হলো—বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, যেন লড়াইরত দুই হরিণ।
আকাশচুম্বী শুল্ক আরোপে বড় ধাক্কা খেয়েছে এই দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসা। অথচ এই দুটি দেশ মিলে গোটা বিশ্বের প্রায় ৩ শতাংশ বাণিজ্য করে থাকে। বলা যায়, বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান সড়কটাই এখন কার্যত বন্ধ।
এর বাস্তব এবং দৃশ্যমান পরিণতি খুব দ্রুতই দেখা যাবে। চীনের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, কর্মীরা কাজ খুঁজতে কারখানা থেকে কারখানায় ঘুরবেন।
জিডিপির পুরো শতাংশীয় পয়েন্টের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বেইজিং বাধ্য হবে প্রণোদনা প্যাকেজ আনতে। বিষয়টি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড় শহর গুঁড়িয়ে যাওয়ার মতো। কষ্টদায়ক হলেও, মূল্য চুকিয়ে সেই দুর্যোগ সামাল দেওয়া সম্ভব—তবে দীর্ঘমেয়াদে তা পারা যাবে না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ভোগ্যপণ্যের দাম হু-হু করে বাড়বে। ট্রাম্প হয়তো মার্কিন কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করবেন দাম না বাড়াতে। কিন্তু তার প্রভাব আসবেই শিগগিরই।
তাত্ত্বিকভাবে বাকি দুনিয়ায় এর চরম বিপরীত চিত্র দেখা যাবে। যেমন কানাডা কিংবা ইউরোপে চীন থেকে আসা পণ্যের এরকম মূল্যবৃদ্ধি হবে না; বরং দাম কমতেও পারে।
বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে অর্থের যুদ্ধ
এই পরিসরের বাণিজ্যযুদ্ধ শুধু পণ্যের প্রবাহে সীমাবদ্ধ থাকে না। ধীরে ধীরে তা সাধারণত অর্থের লড়াইয়ে রূপ নেয়।
গতরাতে আমরা দেখলাম, বাণিজ্য সংঘাতের প্রভাব এবার ছড়িয়ে পড়েছে ঋণ বা ঋণপত্রের বাজারে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড মার্কেটে।
এহেন পরিস্থিতির মাঝেই এক মূল্যবান ইঙ্গিত পাওয়া গেল এই সংঘাতে ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে। ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, বন্ড মার্কেট নিয়েই তারা এখন চিন্তিত।
এশিয়ায় রাতভর মার্কিন সরকারি বন্ডের কার্যকর সুদহার ৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এই ধরনের ঋণের সুদহার এমন অস্থিতিশীল হওয়া উচিত নয়।
সর্বশেষ এমনটা দেখা গিয়েছিল করোনা মহামারির শুরুতে, ২০২০ সালের মার্চে। সারা পৃথিবী তখন জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে ব্যস্ত, আর অর্থনীতি ছিল চরম ভঙ্গুর। সেই সময়ও জরুরি হস্তক্ষেপ করে আরও বড় সংকট এড়াতে হয়েছিল।
কার্যত ট্রাম্পের এই পিছু হটা এক ধরনের জরুরি নীতিগত পরিবর্তনই ছিল।
এশিয়ায় মার্কিন সরকারের বন্ড এভাবে হুড়মুড়িয়ে বিক্রির পেছনে কি চীনের সরকারের হাত ছিল? সম্ভবত না। কিন্তু বুধবারের ঘটনা ট্রাম্পের একটা দুর্বলতা তুলে ধরেছে।
মার্কিন সরকারি বন্ড কেনার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হচ্ছে চীন। চাইলে তারা একসঙ্গে এই সবগুলো বন্ড বিক্রি করে দিতে পারে—যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। তবে সেটা হবে এক আত্মঘাতী অর্থনৈতিক যুদ্ধ, যেখানে চীনের ক্ষতিও হবে ব্যাপক।
তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে বন্ড মার্কেটগুলো। এই মার্কেটগুলো ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে গভীর সন্দেহে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ অবশ্য কিছুটা হলেও এই বন্ড বাজারকে শান্ত রাখতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসার ইঙ্গিত দেননি।
বন্ড মার্কেটের এই সন্দেহ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট-এর অবস্থানে। তিনি এখন মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য বোঝানোর চেষ্টা করছেন ট্রাম্পকে। কারণ চীনকে মোকাবিলা করতে দেশগুলোকে পাশে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের।
যেসব মিত্রদের কিছুদিন আগেও ট্রাম্প ধোঁকাবাজ, লুটেরা বলে অপমান করেছিলেন, এখন তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক হাত মেলানোর কথা হচ্ছে। ট্রাম্পের সেসব অপমানই প্রমাণ করে, প্রথমে এসব দেশের সঙ্গে হাত মেলানোর কোনো পরিকল্পনাই ছিল না।
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। চীন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এখন ইইউ, যুক্তরাজ্য ও জি-৭-কে পাশে প্রয়োজন। আর চীনের দরকার এই দেশগুলোকে অন্তত নিরপেক্ষ রাখা, যাতে তারা চীন থেকে রপ্তানিপণ্য গ্রহণ অব্যাহত রাখতে পারে।
বাকি দুনিয়া ইতিমধ্যে ট্রাম্পের টিমকে পেঙ্গুইন দ্বীপ কিংবা গরিব আফ্রিকান দেশগুলোর ওপর শুল্ক চাপানোর পক্ষে অদ্ভুত যুক্তি দিতে হিমশিম খেতে দেখেছে। আর প্রেসিডেন্টকে যুক্তি দিতে দেখেছে, তিনি বুঝেশুনেই শেয়ারবাজার টালমাটাল করে দিয়েছেন। বাকি বিশ্ব দেখেছে, শুল্ক কার্যকর হওয়ার পরও হঠাৎ করে শুল্কহার বদলে গেছে, আর শুল্কহার ঠিক করা হয়েছে অদ্ভুত ফর্মুলায়।
ট্রাম্প পরিস্থিতি সামলাতে এভাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলায় বাকি বিশ্ব একটা সুবিধা পেয়ে গেছে। শত্রু-মিত্র কেউই এখন আর জানে না এই আমেরিকার সঙ্গে তারা আসলে কী নিয়ে দরকষাকষি করছে।
চরম বিশৃঙ্খলার পর শান্ত, স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে—কিন্তু এই অবস্থা হয়তো বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না।