ভূমিকম্পে ব্যাংককে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে প্রাণের চিহ্ন, মিয়ানমার-থাইল্যান্ডে মৃত ২,০০০

সোমবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ধসে পড়া নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ভয়াবহ ভূমিকম্পের তিন দিন পর আটকে পড়াদের উদ্ধারকাজ আরও জোরদার হয়েছে। এ দুর্যোগে এখন পর্যন্ত অন্তত ২,০০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বহুতল ভবনটির ধ্বংসাবশেষে উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে স্ক্যানিং যন্ত্র ও প্রশিক্ষিত কুকুর মোতায়েন করা হয়েছে। ব্যাংককের ডেপুটি গভর্নর তাভিদা কামোলভেজ জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের তিন দিন পর সেখানে প্রাণের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এখন কীভাবে ওই স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তা নির্ধারণে উদ্ধারকর্মীরা জরুরি ভিত্তিতে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, '৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে জীবিত থাকার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'আমাদের গতি বাড়াতে হবে। ৭২ ঘণ্টা পার হলেও আমরা থামবো না।'
মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি মান্দালয় শহরে ধসে পড়া ভবন থেকে চারজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ও এক কিশোরীও রয়েছেন, বলে চীনের সিনহুয়া সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম সিসিটিভি প্রকাশিত ফুটেজে দেখা গেছে, লাল হেলমেট পরা চীনা উদ্ধারকর্মীরা মান্দালয়ের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে এক জীবিত ব্যক্তিকে উদ্ধার করছেন। তাকে ধাতব তাপ নিরোধক কম্বলে জড়িয়ে ধ্বংসস্তূপের ভাঙা কংক্রিট ও মোচড়ানো লোহার স্তুপের মধ্য দিয়ে বহন করে আনা হয়।

ড্রোনে ধারণ করা ফুটেজে দেখা গেছে, বিশাল এক বহুতল ভবন স্তরে স্তরে ধসে পড়ে কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে কিছু সোনালী প্রলেপযুক্ত বৌদ্ধ মন্দির এখনো অক্ষত রয়েছে।
মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর চলমান গৃহযুদ্ধ ভূমিকম্পে আহত ও গৃহহীনদের কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলেছে। দেশটির ইতিহাসে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় এ ভূমিকম্পে সহায়তা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির আবাসিক প্রতিনিধি আর্নো দ্য ব্যাক রয়টার্সকে জানিয়েছেন, 'সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে সব ক্ষতিগ্রস্তের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে ফ্রন্টলাইন এলাকায় প্রবেশে নিরাপত্তাজনিত নানা সমস্যা রয়েছে।'
মান্দালয় থেকে জীবিত উদ্ধার পাওয়া এক ব্যক্তি জানান, তাকে তার রেস্টুরেন্টের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বের করার পর তিনি নিজ খরচে একটি বুলডোজার ভাড়া করেন। যাতে তার এক কর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা যায় এবং ভবনটি প্রতিবেশীদের জন্য নিরাপদ করা যায়।
এক বিদ্রোহী গোষ্ঠী অভিযোগ করেছে, ভূমিকম্পের পরও মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা গ্রামগুলোতে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্যাংককে ধসে পড়া ভবনে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ভূমিকম্পে ধসে পড়া নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এতে ওই ভবনধসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১২-এ পৌঁছেছে। দেশজুড়ে মোট ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর ভবনটির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ৭৫ জন নিখোঁজ রয়েছে।
প্রাথমিক পরীক্ষায় ধসে পড়া ভবন থেকে সংগ্রহ করা কিছু ইস্পাতের নমুনা মানহীন থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, জানিয়েছেন থাইল্যান্ডের শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে সরকার।
'আমাদের আরও নমুনা সংগ্রহ করতে হবে এবং যথাযথ পরীক্ষা চালাতে হবে, যখনই সুযোগ পাওয়া যাবে,' এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা নন্তিচাই লিকিতাপর্ন।
মিয়ানমারের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সেখানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২,০৬৫-এ দাঁড়িয়েছে। আহত হয়েছেন ৩,৯০০-র বেশি, নিখোঁজ ২৭০ জনেরও বেশি। দেশটির সামরিক সরকার সোমবার থেকে এক সপ্তাহের শোক ঘোষণা করেছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সামরিক শাসকদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, মিয়ানমারে নিহতের সংখ্যা ২,০২৮-এ পৌঁছেছে। তবে ২০২১ সালে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত বিরোধী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্ত দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ২,৪১৮।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে তিনজন চীনা নাগরিক রয়েছেন।
রয়টার্স স্বাধীনভাবে এই সংখ্যা যাচাই করতে পারেনি। ২০২১ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমারে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সামরিক জান্তার প্রধান মিন অং হ্লাইং সতর্ক করে বলেছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ত্রাণ কার্যক্রম
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিভিন্ন দেশকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা সরাসরি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেয়। তারা সতর্ক করেছে, সামরিক জান্তা হয়তো ত্রাণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে পারে বা সহায়তা অন্য দিকে সরিয়ে নিতে পারে।
এক বিবৃতিতে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট জানিয়েছে, 'আমরা জীবন বাঁচাতে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি। এই প্রচেষ্টায় যেকোনো বাধা ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।'
সামরিক জান্তার কোনো মুখপাত্রকে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড ত্রাণ সামগ্রী ও উদ্ধারকর্মী পাঠিয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও রাশিয়াও সহায়তা দিয়েছে।
চীন সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিমের প্রধান ইউয়ে সিন বলেন, 'আমরা কতক্ষণ কাজ করলাম, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবচেয়ে জরুরি হলো—আমরা স্থানীয়দের আশার আলো দিতে পারছি কি না।' ইউয়ে সিন মান্দালয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে লোকজনকে উদ্ধারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বলে জানিয়েছে সিনহুয়া।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, তারা মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া মানুষদের জন্য দ্রুত ত্রাণ সহায়তা পাঠাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মিয়ানমার প্রতিনিধি নোরিকো তাকাগি বলেছেন, 'আমাদের দল মান্দালয়ে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম জোরদারে কাজ করছে, যদিও তারাও ভয়াবহ এই পরিস্থিতির শিকার।'
যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, তারা 'মিয়ানমারে কার্যকর মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর' মাধ্যমে ২০ লাখ ডলারের ত্রাণ দেবে। এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ইউএসএআইডির জরুরি সহায়তা দল মিয়ানমারে মোতায়েন করা হচ্ছে। তবে এজেন্সিটি ব্যাপক বাজেট সংকোচনের মুখে পড়েছে, কারণ দুই মাস আগে দায়িত্ব নেওয়া ট্রাম্প প্রশাসন সংস্থাটি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ভূমিকম্পের ভয়াবহতা নতুন করে দুর্দশা বাড়িয়েছে মিয়ানমারে। দেশটি আগে থেকেই গৃহযুদ্ধের বিশৃঙ্খলায় বিপর্যস্ত। শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে সামরিক বাহিনী উৎখাত করার পর থেকেই সংঘাত আরও তীব্র হয়েছে।
মিয়ানমারে কর্মরত জাতিসংঘের বিশেষ দূত জুলি বিশপ বলেছেন, 'ভূমিকম্প মিয়ানমারের জনগণের গভীরতর দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করে দিয়েছে এবং দেশটির চলমান সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট করেছে।' তিনি ত্রাণ সংস্থাগুলোর জন্য সব এলাকায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান এবং অব্যাহত সামরিক অভিযানের প্রতি নিন্দা জানান।
মিয়ানমার জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো— সেতু, মহাসড়ক, বিমানবন্দর ও রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। এরই মধ্যে চলমান সংঘাত দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে, ৩৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রতিনিধি দ্য ব্যাক বলেন, 'মান্দালয় এবং (রাজধানী) নেপিডোসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিধ্বস্ত সম্প্রদায়গুলো দেখতে পাচ্ছি... মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে, বাড়িতে ফিরতে পারছে না। ফলে রান্নার মতো ন্যূনতম চাহিদাও মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।'
তিনি বলেছেন, 'ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো আগের মতো সেবা দিতে পারছে না। উপরন্তু, সংকট আরও বাড়ায় বাড়তি চাহিদা মেটানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।'