২০৪০ সালের আগেই হারিয়ে যেতে পারে আপনার ফোনের সব ছবি

কয়েক সপ্তাহ আগে, লেখক ও সম্পাদক টম মে তার চিলেকোঠা ঘেঁটে বাবা-মায়ের পুরোনো দিনের ছবির অ্যালবামগুলো দেখছিলেন। এক এক করে অ্যালবামের পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ তার চোখে পড়ে নব্বইয়ের দশকের কিছু ফিকে হয়ে যাওয়া ছবি—পারিবারিক ছুটি, জন্মদিন কিংবা নিছকই সাদামাটা দিনগুলোর ফ্রেমে বন্দি মুহূর্তগুলো।
বিস্ময়করভাবে, সেই আগের আমলের পুরোনো ছবিগুলো আজও অক্ষত, অথচ টমের নিজ হাতে তোলা কত শত ডিজিটাল ছবি এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে!
কয়েকদিন আগেও, ২০০৯ সালে রোমানিয়া সফরে তোলা ছবিগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজছিলেন টম—ছবিগুলো তার প্রথম ডিজিটাল এসএলআর ক্যামেরায় তোলা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুঁজে তিনি তার হার্ড ড্রাইভ, ক্লাউড অ্যাকাউন্ট আর পুরোনো ফোল্ডারগুলোতে পেয়েছেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ছবি। বাকি সব ছবি যেন হারিয়ে গিয়েছে কোনও এক অদৃশ্য 'ডিজিটাল শূন্যতায়'।
হয়ত হার্ড ড্রাইভ নষ্ট হয়ে গেছে, অ্যাকাউন্ট বদলে গেছে, কিংবা কোনো ফরম্যাট পুরোনো হয়ে গিয়েছে।
যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে টম ছবি সংরক্ষণের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিশ্বাস করতেন, সেখান থেকে হারিয়ে গেছে তার অমূল্য স্মৃতিগুলো। তবে এসব ঘটনা মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়।
গত মাসে, গুগল ফটোস [গুগলের ক্লাউড ছবির সার্ভার] থেকে টম একটি ই-মেইল পান। তাকে জানানো হয়, যদি তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লগইন না করেন তবে পুরোনো অ্যালবামগুলো মুছে ফেলা হবে।
টমের পরিচিত একজন পেশাদার আলোকচিত্রী মাত্র ৩০ দিনের নোটিশে ক্লাউড সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুরো দশ বছরের ছবি হারিয়েছেন। এমনও দেখা গেছে যে, পুরোনো ক্যামেরায় তোলা ফাইলগুলো আর বর্তমান সফটওয়্যারে খোলার উপায় নেই।
বর্তমানে আমরা এমন একটি অদ্ভুত যুগ পার করছি, যেখানে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় মানুষ এখন সর্বোচ্চ সংখ্যক ছবি তুলছে। শুধু ২০২৪ সালেই বিশ্বজুড়ে তোলা হয়েছে আনুমানিক ১.৪ ট্রিলিয়ন ছবি!
অথচ, এ ছবিগুলোর বড় একটি অংশই হয়ত টিকবে না পরবর্তী দশক পর্যন্ত। আমরা হচ্ছি ইতিহাসের সবচেয়ে 'অসংরক্ষিত' প্রজন্ম!
যেখানে আমাদের দাদাদের হলদেটে 'কোডাক' এবং পরদাদাদের সেপিয়া প্রিন্টের ছবি আজও অক্ষত, সেখানে আমাদের ডিজিটাল স্মৃতিগুলো ঝুঁকির মুখে—কারণ এগুলো সংরক্ষণের জন্য নয়, পরিবর্তনের জন্য তৈরি এমন এক প্রযুক্তিগত কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল।
ভাবুন তো, আপনার একটি ডিজিটাল ছবি ২০৪০ সাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হলে আপনাকে কতগুলো শর্ত পূরণ করতে হবে?
ফাইল ফরম্যাট টিকিয়ে রাখা, নির্ভরযোগ্য স্টোরেজ ডিভাইস, সক্রিয় অ্যাকাউন্ট, ভালো প্রযুক্তি কোম্পানি, কার্যকরী পাসওয়ার্ড ও যাচাইকরণ প্রক্রিয়া, ছবির সঙ্গে থাকা মেটাডেটাও থাকতে হবে সংরক্ষিত, আরও কত কী!
এই নিয়মগুলোর যেকোনও একটিতে বিন্দুমাত্র হেরফের হলে, আপনার সেই ছবির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যেতে পারে!
তবে এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত সংকট নয়, পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও। আগে ছবি তোলা হতো কোনো অর্থবহ মুহূর্ত ধরে রাখার জন্য, ক্যামেরা হাতে তুলে নিলে সেটির পেছনে ছিল একটি বিশেষ উদ্দেশ্য।
কিন্তু এখন? প্রতি বছর আমরা হাজার হাজার ছবি তুলি ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর একটিকেও আলাদা করে সংরক্ষণ করার মানসিকতা বা অভ্যাস আমাদের গড়ে ওঠেনি। ফোনের গ্যালারিতেই তো ছবি আছে, ডিলিট করা হয়নি—তাই আমাদের কাছে মনে হয় ছবিগুলো নিরাপদ ও সংরক্ষিত।
ডিজিটাল ছবি স্পর্শ করা যায় না, ফলে সেগুলোর প্রতি আবেগও কমে যায়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আর ক্লাউড সবসময় নতুন ছবি বা ভিডিওকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই পুরোনো ছবিগুলো আমাদের অজান্তেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় 'ডিজিটাল অন্ধকারে'।
সেক্ষেত্রে প্রযুক্তিব্যবস্থাই দায়ী বেশি। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে, যেখানে পুরোনো ছবি ভুলে যাওয়াটাই যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা যখন ছবি ক্লাউডে সংরক্ষণের জন্য আপলোড করি, তখন মনে করি সেগুলো নিরাপদ। কিন্তু আসল কথা হলো, ছবিগুলোর নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সাবস্ক্রিপশন, অ্যাকাউন্ট সক্রিয়তা এবং প্ল্যাটফর্মের নিয়মকানুনের ওপর।
'টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন'-এ [শর্তাবলী] অনেক সময়ই লেখা থাকে—নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্টের ডেটা মুছে ফেলার অধিকার কোম্পানির আছে। আবার এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আরেকটিতে ছবি সরানোর প্রক্রিয়াও ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল রাখা হয়।
টমের এক অভিজ্ঞতার কথা শোনানো যাক। একবার নিউজিল্যান্ড সফরের সময় তিনি একটি পোষা প্রাণী দেখাশোনার সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। সম্প্রতি সেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার আগে তাকে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে ছবি ও তথ্য ডাউনলোড করতে হয়েছিল, কারণ এক ক্লিকে সব ডাউনলোডের সুবিধা ছিল না—যদিও প্রযুক্তিগতভাবে সেটি সম্ভব ছিল।
তবে সব প্রতিষ্ঠান এক নয়। এক্ষেত্রে গুগল তুলনামূলকভাবে ব্যতিক্রম—তাদের নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা মেনে সহজেই নিজের তথ্য ও ছবি ডাউনলোড করা যায়।
অবশ্য কারো কারো ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা কম থাকলেও, সাবস্ক্রিপশনের মতো খরচ বহুল সেবা অনেকের জন্য ছবি সংরক্ষণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ডিজিটাল ছবি সংরক্ষণ করার খরচও তো কম নয়। ক্লাউড স্টোরেজের জন্য বার্ষিক কিংবা মাসিক ফি দিতে হয়। হার্ড ড্রাইভ কয়েক বছরে একবার বদলাতে হয়। পেশাদার ব্যাকআপ ব্যবস্থা নিলে খরচ আরও বাড়ে।
ফলে স্মৃতির ছবিগুলো এমন এক সম্পদে পরিণত হয়, যেগুলো টিকিয়ে রাখতে প্রতি মাসে বা বছরে এক ধরনের 'সংরক্ষণ কর' (ট্যাক্স) দিতে হয়।
এসব প্রযুক্তির জটিলতায় অনেকেই আবার ফিরে যাচ্ছেন ফিল্ম ক্যামেরা কিংবা ছাপানো ছবির দিকে। কেউ গড়ে তুলছেন জটিল ব্যাকআপ সিস্টেম—একাধিক ড্রাইভ, একাধিক লোকেশন, একাধিক ক্লাউড অ্যাকাউন্ট।
কিন্তু সত্য কথা হলো, এসব আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? যদি পেশাদারিত্ব বা গভীর ভালোবাসা নিয়ে ছবি তোলা হয়, তবেই হয়ত এসব যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়, নাহলে না।
আর এদিকে টমের বাবা-মায়ের চিলেকোঠার সেই পুরোনো অ্যালবামগুলোর মতো আমাদের ঘরের আলমারিতেও সংরক্ষিত আছে আমাদের বাবা-মা ও পূর্ব প্রজন্মের ছাপানো ছবি—কোনো পাসওয়ার্ড, সাবস্ক্রিপশন বা সফটওয়্যার পরিবর্তনের ঝামেলা ছাড়াই।
প্রশ্ন থেকেই যায়, আমাদের ডিজিটাল ছবিগুলো কি এতদিন টিকে থাকতে পারবে? হয়ত না।
হয়ত ২০৪০ সালের দিকে এসে আমরা বুঝতে পারব, আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তগুলো আমাদের আড়চোখে নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে—আর সেই সময় আমরা ব্যস্ত ছিলাম নতুন নতুন ছবি তুলতে।
অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা