সশস্ত্রবাহিনী কীভাবে কাজ করবে, জাতীয় নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে ইসির পরিকল্পনা কী?

বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় এখন সশস্ত্র বাহিনী মাঠে রয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের দায়িত্ব ও সমন্বয়সহ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সোমবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা ও প্রাক প্রস্তুনিমূলক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানসহ সেনা, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা অংশ নেন।
নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন পরিকল্পনার বিষয় সভায় ইসি তুলে ধরে।
সভা সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ভোটকেন্দ্রে পুলিশ, আনসার ও ক্ষেত্রবিশেষ গ্রাম পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। তাছাড়া নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছিল। ইন এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনী থেকে স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছিল।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রে ও নির্বাচনী এলাকায় সেনা মোতায়েনসহ এ বিষয়ক পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজন হবে বলে সভায় ইসি জানিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ইসি সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, 'সেনাবাহিনী ইন টু সিভিল পাওয়ারের মাঠে রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে ইসি।'
এক্ষত্রে সশস্ত্র বাহিনী আগামী নির্বাচনে ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারে থাকবে, নাকি তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে থাকবে- তা জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, 'এ ব্যাপারে আরপিওটা সংশোধন হয়ে আসুক। দুটো মতামতই আছে।'
ইসি সচিব বলেন, 'আপনার সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন, ডেপ্লয়মেন্ট আছে ইন টু সিভিল পাওয়ার। তাদের অবস্থানটা কী হবে সেটা আমরা বলেছি- নীতিগতভাবে তারা যে অবস্থানে; যে যার অবস্থানে আছেন, আমরা এম্ফাসাইজ (জোর দেওয়া) করেছি ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিংয়ের বিষয়টি।'
সীমান্ত এলাকা, উপকূলীয় এলাকা বিবেচনায় কাজের ধরনের বিষয়টি তুলে ধরে আখতার আহমেদ বলেন, 'এটা সমন্বয় করলে ভালো হবে। … এ রকম জায়গাগুলো নিয়ে আরেকটু ফার্নিশ (সাজানো) করতে হবে।'
নির্বাচন সামনে রেখে সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ইসি একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সেই সঙ্গে ইসি আজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে এসব পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপন করে।
ভোটকেন্দ্র থেকে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয়, ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ, ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণে বডি-ওর্ন ক্যামেরা, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা, স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিরাপত্তা, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ন্ত্রণ, পাহাড়ি এলাকায় হেলিকপ্টার সহায়তা এবং নির্বাচনী অফিসগুলোর নিরাপত্তা জোরদারসহ অন্তত ১৪টি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতামতের ভিত্তিতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে বলেও জানানো হয়।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তিন ধাপে কাজ করবে—তফসিল ঘোষণার আগে, ভোটের সময় ও ভোটের পর। প্রতিটি ধাপে আলাদা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও দায়িত্ব বণ্টনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইসি সচিব বলেন, 'এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা মোটামুটিভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। মূলত পাঁচ দিনের ডেপ্লয়মেন্ট প্রোগ্রাম করা হয়। সেখানে একটা প্রস্তাব এসেছে যে এটা যেন আট দিন করা হয়। নির্বাচনের আগে তিন দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন পরবর্তী চারদিন। আমাদের প্রাথমিক প্রোগ্রামিং ছিল পাঁচ দিন। এখন প্রস্তাবনাটা আসছে আট দিন। এটা আমরা পরীক্ষা করে দেখব।'
তফসিল ঘোষণার আগের পদক্ষেপ
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় 'চিহ্নিত সন্ত্রাসী', দুষ্কৃতকারী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ইসি সচিব সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর বিষয়ে উনারা বলেছেন এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ অস্ত্র তারা উদ্ধার করেছেন। আরো কিছু অস্ত্র এবং কিছু গোলাবারুদ এখন পর্যন্ত আছে। কিন্তু প্রক্রিয়া চালু আছে।'
তফসিল ঘোষণা থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনী এলাকায় সন্দেহভাজন বা বহিরাগত অনুপ্রবেশ রোধে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী মোতায়েন থাকবে।
রিটার্নিং অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।
ভোট-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা
নির্বাচনের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে থাকবে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে। পাশাপাশি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি দ্রুত বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধের প্রস্তাব
ইসি মনে করছে, ভোটের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার স্বার্থে নির্বাচনী এলাকায় ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা জরুরি। কারণ, অননুমোদিত ড্রোনে ভিডিও ধারণ বা বিস্ফোরক বহনের ঝুঁকি রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ভোটের প্রচারে ড্রোনের ব্যবহার নিষেধ রাখা হয়েছে। তবে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ব্যবহার করতে পারবে।
ভোটে কোন বাহিনীর কত সদস্য, বডি-ওর্ন ক্যামেরা
আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে আইজিপি'র তথ্য তুলে ধরে ইসি সচিব জানান, পুলিশের দেড় লাখ কর্মী থাকবে ভোটে। সবচেয়ে বেশি বাহিনীর সদস্য আসবে আনসার ভিডিপি থেকে। স্বরাষ্ট্র সচিব বলেছেন, বডি-ওর্ন ক্যামেরা থাকবে; ড্রোনের ব্যবস্থা থাকবে।
তিনি জানান, সেনাবাহিনীর সদস্যের কথা বলেছে ৯০ হাজার থেকে এ লাখ। আনসারের সংখ্যাটা আরেকটু বেশি। আনসার ভিডিপি প্রায় সাড়ে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ সদস্য।
উল্লেখ্য, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে রমজান শুরুর আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করবে ইসি।