বুড়িয়ে যাচ্ছে ভারতের জনসংখ্যা

একটি শিশু যদি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জন্মদিন অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে জন্মাত, তবে সম্ভবত গত মাসের ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন পর্যন্ত সে বেঁচে থাকতে পারত না। সে সময় ভারতের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪১.২ বছর, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় প্রায় পাঁচ বছর কম।
তবে সময়ের সঙ্গে দেশটি এই ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২৩ সালে ভারতের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর, যা বৈশ্বিক গড়ের মাত্র এক বছর কম। ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার দেশ হওয়াতে এই উন্নতি আরও তাৎপর্যপূর্ণ।
জনস্বাস্থ্যের এই উন্নয়ন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে, বিশেষত যখন দেশের ১৪০ কোটি মানুষের অর্ধেকই ২৯ বছরের কম বয়সী। এই বিশাল ও ক্রমবর্ধমান কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে, যা জনমিতিক মুনাফা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) হিসেবে পরিচিত।
গবেষণা সংস্থা ম্যাকিন্সে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (এমজিআই)-এর হিসাব অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে এই জনমিতিক মুনাফা ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বছরে অতিরিক্ত ০.৭ শতাংশ যুক্ত করেছে।
তবে এই সাফল্যের সঙ্গে নতুন এক চ্যালেঞ্জও এসেছে—ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশটির প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে দেশটিতে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ৩৫ কোটিতে পৌঁছাবে, যা আজকের যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।
ফলে আগামী ২৫ বছরে ভারতের জনমিতিক মুনাফা কমতে থাকবে। তখন এটি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বছরে মাত্র ০.২ শতাংশ যোগ করতে পারবে। এমজিআই-এর বিশ্লেষক অনু মাধবগড়কার মনে করেন, ভারতের সামনে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য মাত্র একটি প্রজন্ম সময় রয়েছে। এরপর দেশের জনসংখ্যাগত কাঠামো হবে উত্তর আমেরিকার মতো, কিন্তু মাথাপিছু আয় থাকবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
যদি ভারত ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আগেই এর অধিকাংশ জনগোষ্ঠী বয়স্ক হয়ে যায়, তবে দেশের উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন বাধাগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি, অবসর গ্রহণের পর প্রবীণদের জন্য জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে প্রতি প্রবীণের বিপরীতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯.৮। কিন্তু ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতির কাছাকাছি পৌঁছাবে এবং শতকের শেষে তা মাত্র ১.৯-এ নেমে আসবে, যা আজকের জাপানের সমান।
যেহেতু কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমবে, আবার প্রবীণদের জন্য সঞ্চয় ব্যবস্থাও দুর্বল, তাই অনেক বয়স্ক মানুষ দুর্দশায় পড়তে পারেন। একই সঙ্গে, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সরকারি পরিষেবা চাপের মুখে পড়বে।
এছাড়া ব্যক্তি ও সরকারের আয়ের একটি বড় অংশ প্রবীণদের সেবায় ব্যয় করতে হবে, যা তরুণদের ব্যয় ও সঞ্চয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে। এর ফলে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বিশেষত নারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে, কারণ তারা সাধারণত পুরুষদের তুলনায় বেশি সময় বাঁচেন। ভারতের কিছু রক্ষণশীল সমাজে এখনো বিধবাদের কঠোর জীবনযাপন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর সম্পদ স্ত্রী ও সন্তানের মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে বিধবারা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
যদিও সরকার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন নীতিমালা চালু করেছে, তবে এর বাস্তবায়ন এখনও সীমিত। এনজিও 'এজওয়েল'-এর প্রধান হিমাংশু রাঠের মতে, বেশিরভাগ নীতিই কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ-এর গবেষক সোনালদে দেশাই বলেন, দরিদ্র প্রবীণ ও বিধবাদের জন্য সরকার পেনশন দিলেও তা স্বচ্ছল জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়।
এর পাশাপাশি, ভারতের পেনশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত জটিল। দেশটিতে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় প্রবীণদের প্রতি বছর 'লাইফ সার্টিফিকেট' জমা দিতে হয়, যা তাদের জীবিত থাকার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অনেক প্রবীণ এই জটিল ও অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সামলাতে পারেন না।
গত বছর সরকার ৭০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের জন্য বিনামূল্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমার ঘোষণা দেয়। এটি ইতিবাচক উদ্যোগ হলেও এই পরিকল্পনায় প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা বা বহির্বিভাগের সেবা অন্তর্ভুক্ত নেই। মধ্যবিত্তদের জন্যও পরিস্থিতি সহজ নয়। যদিও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা পাওয়া যায়, তবে প্রবীণদের জন্য তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এতে নানা বিধিনিষেধ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এর পাশাপাশি, সমাজের পরিবর্তিত কাঠামো প্রবীণদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ভাঙনের ফলে ছোট পরিবারগুলো বাড়ছে, কর্মসংস্থানের খোঁজে তরুণরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে, ফলে বয়স্করা আরও একা হয়ে পড়ছেন।
অথচ ভারতীয় সংস্কৃতিতে এখনো অ্যাসিস্টেড লিভিং বা বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা তেমনভাবে গৃহীত হয়নি। ফলে একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও হতাশার সঙ্গে লড়াই করাই প্রবীণদের জন্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যান্য দেশের মতো ভারতের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানও নির্ভর করবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো, আরও আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং অবসর গ্রহণের বয়স বৃদ্ধি করার ওপর। তবে স্বল্পমেয়াদে সৃজনশীল সমাধানের প্রয়োজন রয়েছে।
মধ্য ভারতের ভেন্দালি গ্রামে এমনই একটি সমাধানকে দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখা যেতে পারে। ১ হাজার ১৩৬ জন বাসিন্দার এই গ্রামে ১৫৪ জন (১৪ শতাংশ) প্রবীণ। 'জনসেবা' নামক একটি প্রবীণ ডে-কেয়ারের উদ্যেগে প্রতিদিন বিকেলে গ্রামের বৃদ্ধ নারীরা নদীর ধারে একটি মন্দিরে তিন ঘণ্টার জন্য একত্র হন। সেখানে তারা গান করেন, যোগব্যায়াম করেন এবং হালকা শরীরচর্চার মাধ্যমে সময় কাটান।
এই কেন্দ্রে আসা ৯০ বছর বয়সী লক্ষ্মীবাই বলেন, 'আগে আমাদের একত্র হওয়ার জায়গাই ছিল না। এখানে আসলে মনে হয় কেউ আমাদের কথা শোনে, আর ব্যায়ামের কারণে শরীরেও পরিবর্তন এসেছে।'
ডে-কেয়ারের স্বেচ্ছাসেবকেরা নিয়মিত তাদের রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করেন, ফলে আগেভাগেই বিভিন্ন স্বাস্থ্যসমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এখন তারা গ্রামের উৎসব-অনুষ্ঠানে আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং কখনো কখনো মন্দির ভ্রমণেরও আয়োজন করা হয়।
ভারত প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধিতে নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়েছে। এখন নিশ্চিত করতে হবে, সেই দীর্ঘ জীবন যেন ভালোভাবেই কাটে।