শিক্ষকেরাও ব্যবহার করছেন চ্যাটজিপিটি, তবে কিছু শিক্ষার্থী এতে অখুশি

ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সিনিয়র শিক্ষার্থী এলা স্ট্যাপলটন ক্লাসের লেকচার নোট পড়ছিলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ল অদ্ভুত এক ব্যাপার। নেতৃত্ব-বিষয়ক সেই নোটের মাঝখানে লেখা একটি নির্দেশ—'সবগুলো বিষয় আরও বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলো।' এই নির্দেশটি ছিল চ্যাটজিপিটি-কে দেওয়া। তার ঠিক পরেই নেতৃত্বের ভালো-মন্দ দিকগুলো বুলেট পয়েন্ট দিয়ে সাজানো।
এলা সাথে সাথেই ক্লাসের এক বন্ধুকে মেসেজ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখলেন, 'স্যার যে নোট দিয়েছেন, দেখেছিস? পুরোটাই চ্যাটজিপিটি দিয়ে বানানো।'
বন্ধুর অবাক উত্তর, 'বলিস কী! এটা কী ধরনের কথা?'
ব্যাপারটা এলাকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি তার অধ্যাপকের পুরনো স্লাইড প্রেজেন্টেশনগুলো ঘাঁটতে শুরু করলেন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের আরও অনেক প্রমাণ খুঁজে পেলেন। কোথাও লেখা বিকৃত, কোথাও ছবিতে মানুষের অতিরিক্ত হাত-পা, আবার কোথাও মারাত্মক সব বানান ভুল।
এই ঘটনায় তিনি প্রচণ্ড হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশছোঁয়া খরচ আর সুনামের কারণে তিনি সেরা মানের শিক্ষাই আশা করেছিলেন। যে কোর্সের সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, সেই কোর্সের শিক্ষক নিজেই তা ব্যবহার করছেন!
এলা বলেন, 'তিনি আমাদের এআই ব্যবহার করতে নিষেধ করছেন, অথচ নিজেই তা দেদারসে ব্যবহার করছেন।'
এরপর এলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি শুধু শিক্ষকের এআই ব্যবহারের কথাই বলেননি, তার পড়ানোর ধরন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এমনকি সেই কোর্সের জন্য দেওয়া টিউশন ফি, যা প্রায় ৮,০০০ ডলারেরও বেশি, তা ফেরত চেয়ে বসেন।
বদলে যাওয়া চিত্র
২০২২ সালের শেষের দিকে চ্যাটজিপিটি আসার পর বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য নকল করাটা হয়ে গিয়েছিল পানির মতো সোজা। ইতিহাস বা সাহিত্যের যেকোনো প্রবন্ধ কয়েক সেকেন্ডেই তৈরি করে দিচ্ছিল এই টুল। অনেক স্কুল-কলেজ এটি নিষিদ্ধ করে, আবার কেউ কেউ এআই শনাক্তকারী সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু করে।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি উল্টে গেছে। এখন শিক্ষার্থীরাই তাদের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এআই-এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার অভিযোগ তুলছে। 'রেট মাই প্রফেসর'-এর মতো ওয়েবসাইটে তারা শিক্ষকদের কোর্স ম্যাটেরিয়াল খুঁটিয়ে দেখছে, চ্যাটজিপিটির বহুল ব্যবহৃত শব্দ, যেমন—'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ' বা 'গভীরভাবে আলোচনা' ইত্যাদি খুঁজে বের করছে। শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে মানুষের কাছে পড়তে এসেছে, কোনো যন্ত্রের কাছে নয়, যা তারা নিজেরাও বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারে।
অন্যদিকে, অধ্যাপকরা বলছেন, তারা উন্নত শিক্ষা দেওয়ার একটি মাধ্যম হিসেবেই এআই ব্যবহার করছেন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাথে কথা বলা বেশ কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, চ্যাটবট তাদের সময় বাঁচায়, কাজের চাপ কমায় এবং একজন স্বয়ংক্রিয় সহকারীর মতো কাজ করে।
আর এই সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছেই। টাইটন পার্টনার্স নামে একটি পরামর্শক গোষ্ঠীর সমীক্ষা অনুযায়ী, গত বছর আমেরিকার ১৮ শতাংশ শিক্ষক নিজেদেরকে এআই টুলের নিয়মিত ব্যবহারকারী বললেও, এ বছর সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ওপেনএআই এবং অ্যানথ্রপিকের মতো প্রযুক্তি সংস্থাগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বিশেষ চ্যাটবট তৈরি করে এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
এটা স্পষ্ট যে, শিক্ষাব্যবস্থায় এআই এখন একটি বাস্তবতা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। এখন শিক্ষকেরাই প্রযুক্তির মারপ্যাঁচ এবং শিক্ষার্থীদের অসন্তোষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ব্যবহার যখন গ্রেডিং-এ
গত বছর সাউদার্ন নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ম্যারির (২২) অভিজ্ঞতা ছিল আরও তিক্ত। অনলাইন নৃবিজ্ঞান কোর্সের একটি প্রবন্ধে তিনি 'এ' গ্রেড পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু মন্তব্যের অংশে তার অধ্যাপক ভুল করে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথোপকথনটি পেস্ট করে দেন। সেখানে লেখা ছিল, চ্যাটবটকে কী ধরনের গ্রেডিং পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে এবং ম্যারিকে লেখার জন্য কিছু 'সুন্দর প্রতিক্রিয়া' তৈরি করে দিতে হবে।
ম্যারি বলেন, 'আমার মনে হয়েছে, অধ্যাপক আমার লেখা এক লাইনও পড়েননি।' তবে তিনি তার শিক্ষকের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি, কারণ তিনি জানতেন যে তার অনেক শিক্ষকের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোটা ছিল একটি খণ্ডকালীন চাকরি।
তবুও, তিনি বিষয়টি নিয়ে তার অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলেন। অধ্যাপক স্বীকার করেন যে তিনি শিক্ষার্থীদের লেখা পড়েন, কিন্তু স্কুল থেকে অনুমতি থাকায় চ্যাটজিপিটি-কে একটি গাইড হিসেবে ব্যবহার করেন। এর কিছুদিন পর যখন আরেকজন শিক্ষক তার লেখায় একইভাবে চ্যাটজিপিটি দিয়ে মন্তব্য করেছেন বলে মনে হলো, তখন ম্যারি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ই ছেড়ে দেন।
ওহাইও ইউনিভার্সিটির ইংরেজির অধ্যাপক পল সোভলিন বলেন, তিনি ম্যারির হতাশা বুঝতে পারছেন। তিনি নিজেও একজন এআই ফ্যাকাল্টি ফেলো, যার কাজ হলো শিক্ষায় এআই-এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, 'শিক্ষক হিসেবে আমাদের মূল কাজ হলো শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া জানানো। তাদের লেখার সঙ্গে মানবিক সংযোগ স্থাপন করাটাই আসল।'
ড. সোভলিন শিক্ষাদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অন্তর্ভুক্ত করার একজন সমর্থক, তবে তার উদ্দেশ্য শুধু শিক্ষকের জীবন সহজ করা নয়। তিনি মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অবশ্যই এই প্রযুক্তি দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার করতে শিখতে হবে এবং এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি 'নৈতিক কম্পাস' তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, 'কারণ, কর্মজীবনে তাদের প্রায় নিশ্চিতভাবেই এটি ব্যবহার করতে হবে।' এর সঠিক ব্যবহারে ব্যর্থ হলে তার পরিণতিও হতে পারে মারাত্মক। ড. সোভলিন সরাসরি বলেন, "যদি তুমি কোনো গড়বড় করো, তবে তোমার চাকরি চলে যাবে।"
তিনি একটি উদাহরণ টেনে বলেন: ২০২৩ সালের ঘটনা। ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা এক বন্দুক হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের কাছে ঐক্য ও সম্প্রীতির আহ্বান জানিয়ে একটি ইমেল পাঠিয়েছিল। সেই বার্তায় 'একে অপরের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে' একটি 'যত্নের সংস্কৃতি তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ইমেলের শেষে একটি বাক্য ছিল, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে পুরো বার্তাটি চ্যাটজিপিটি দিয়ে লেখানো হয়েছিল। যন্ত্রের কাছে সহানুভূতির বার্তা লিখিয়ে নেবার এই ঘটনায় শিক্ষার্থীরা তীব্র সমালোচনা শুরু করে। এর ফলে, ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তারা সাময়িকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

তবে সব পরিস্থিতি এত সহজ বা স্পষ্ট নয়। ড. সোভলিন বলেন, এআই ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করা বেশ কঠিন, কারণ বিষয়ভেদে এর যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার ভিন্ন হতে পারে।
অধ্যাপকদের মধ্যেও এআই ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো ঐক্যমত নেই। কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নে এটি ব্যবহার করাকে সমর্থন করেন, আবার অন্যরা এর তীব্র বিরোধী। কেউ শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি স্বচ্ছ রাখতে চান, আবার কেউ শিক্ষার্থীদের সন্দেহের কারণে তা গোপন রাখেন।
তবে বেশিরভাগ অধ্যাপকই মনে করেন, এলা স্ট্যাপলটনের শিক্ষকের ক্লাস নোট বা স্লাইড তৈরিতে এআই ব্যবহার করাটা তেমন কোনো সমস্যা নয়। ড. সোভলিনের মতে, অধ্যাপক যদি চ্যাটজিপিটির তৈরি করা তথ্য নিজের দক্ষতা দিয়ে সম্পাদনা ও যাচাই করে নেন, তবে তা গ্রহণযোগ্য।
শক্তিশালী এক ক্যালকুলেটর?
ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটির বিজনেস প্রফেসর শিংগিরাই ক্রিস্টোফার কোয়ারাম্বা চ্যাটজিপিটিকে তার 'অংশীদার' বলে মনে করেন। তিনি বলেন, 'যে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করতে আগে কয়েক দিন লাগত, এখন তা কয়েক ঘণ্টায় হয়ে যায়। আমি এটিকে দেখি স্টেরয়েড দেওয়া কোনো ক্যালকুলেটরের মতো।' এর ফলে তিনি এখন শিক্ষার্থীদের বেশি সময় দিতে পারেন।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক ডেভিড মালান তার কোর্সের জন্য একটি বিশেষ এআই চ্যাটবট তৈরি করেছেন। তার শত শত শিক্ষার্থী এখন কোডিংয়ের সমস্যায় পড়লে এই চ্যাটবটের সাহায্য নেয়। এর ফলে শিক্ষাদান সহকারীদের ওপর চাপ কমেছে এবং তারা শিক্ষার্থীদের সাথে আরও গঠনমূলক কাজে সময় দিতে পারছেন।
তবে এর একটি সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকও তুলে ধরেছেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেটি পিয়ার্স। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, 'যদি শিক্ষাদান সহকারীদের বেশিরভাগ কাজ এআই দিয়ে করানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এই কাজটি যারা করতো তাদের কী হবে?' তিনি স্বীকার করেন, 'এটি অবশ্যই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।'
শেষ পর্যন্ত যা হলো
নর্থইস্টার্নে অভিযোগ জানানোর পর এলা স্ট্যাপলটনকে বেশ কয়েকটি বৈঠকে বসতে হয়। কিন্তু স্নাতক অনুষ্ঠানের পরের দিন তাকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তিনি টিউশন ফি ফেরত পাচ্ছেন না।
তার অধ্যাপক রিক অ্যারোউড অবশ্য এই ঘটনায় অনুতপ্ত। তিনি স্বীকার করেন যে, তার ক্লাস নোটগুলোকে একটি 'নতুন রূপ' দেওয়ার জন্য তিনি কয়েকটি এআই টুলে আপলোড করেছিলেন। প্রথম দেখায় সেগুলো তার কাছে ভালোই মনে হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'ভেবে দেখলে, আমার ওগুলো আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখা উচিত ছিল।' এই বিব্রতকর পরিস্থিতি তাকে শিখিয়েছে যে, অধ্যাপকদের এআই ব্যবহারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত এবং শিক্ষার্থীদের কাছে এর ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা প্রয়োজন।
ড. অ্যারোউড বলেন, 'আমার মূল উদ্দেশ্যই হলো শেখানো। যদি আমার অভিজ্ঞতা থেকে অন্যরা কিছু শিখতে পারে, তবে তাতেই আমার আনন্দ।'
এদিকে, নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি সম্প্রতি এআই ব্যবহারের একটি আনুষ্ঠানিক নীতি জারি করেছে, যেখানে এআই ব্যবহার করলে তার উৎস উল্লেখ করা এবং তথ্যের নির্ভুলতা যাচাই করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, প্রযুক্তি এবং মানবিকতার এই লড়াইয়ে সবাই এখনও শিখছে এবং মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।