নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভারত থেকে নিজ দেশে ফিরে আসছেন উদ্বিগ্ন নেপালি অভিবাসীরা

উত্তর ভারতের লখনৌয়ের এক বাসস্ট্যান্ডে উদ্বিগ্ন মুখগুলো যেন নিজেদের গল্পই বলছে। একসময় কাজের সন্ধানে ভারতে আসা নেপালিরা এখন দ্রুত সীমান্ত পেরিয়ে স্বদেশে ফিরছেন, কারণ কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অস্থিরতার কবলে পড়েছে তাদের দেশ।
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের জেরে সৃষ্ট সংঘর্ষে ৩০ জনের মৃত্যুর পর চলতি সপ্তাহের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। যদিও পদত্যাগের আগেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল, কিন্তু 'জেন জি' বা তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। অলির পদত্যাগের পর নেপালে এখন কোনো স্থায়ী সরকার নেই।
অভিবাসী নেপালি শ্রমিকদের জন্য এই পরিস্থিতি বেশ ভীতিকর। সরোজ নেভারবানী বলেন, 'দেশে সমস্যা চলছে, তাই আমাকে ফিরতেই হবে। আমার বাবা-মা সেখানে আছেন–পরিস্থিতি গুরুতর।' পেসাল এবং লক্ষ্মণ ভট্টের মতো অন্যরাও একই রকম অনিশ্চয়তার কথা জানান, 'আমরা কিছুই জানি না, কিন্তু বাড়িতে থাকা লোকজন আমাদের ফিরে যেতে বলেছে।'
ভারতে বসবাসকারী নেপালিরা মূলত তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত।
প্রথমত, একদল অভিবাসী শ্রমিক রয়েছেন যারা পরিবার ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে বাবুর্চি, গৃহকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী বা স্বল্প বেতনের অন্যান্য কাজে নিযুক্ত। তারা নেপালি নাগরিক হিসেবেই থাকেন, দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া করেন, তবে তাদের ভারতীয় আধার কার্ড (ভারতের বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র) থাকে না এবং প্রায়শই মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন। এজন্য তাদের অনেক সময় মৌসুমী অভিবাসী বলা হয়।
দ্বিতীয়ত, যারা পরিবারসহ ভারতে স্থায়ী হন এবং জীবন গড়ে তোলেন। তারা প্রায়শই স্থানীয় পরিচয়পত্র পান, তবুও নেপালি নাগরিকত্ব ও দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন, এমনকি ভোট দিতে দেশের ফিরেও যান।

তৃতীয়ত, নেপালি বংশোদ্ভূত ভারতীয় নাগরিক, যারা ১৮ থেকে ২০ শতকের অভিবাসনের পূর্ববর্তী বংশধর। ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও তারা নেপালের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার দাবি করেন।
সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের তালিকায় নেপাল শীর্ষে। প্রায় ৪৭ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ হাজারেরও বেশি নেপালি। এছাড়াও বহু নেপালি ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বা পারিবারিক সাক্ষাতের জন্য ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার উন্মুক্ত সীমান্ত পাড়ি দেন। ১৯৫০ সালের শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি এবং শক্তিশালী সামাজিক নেটওয়ার্ক এই যাতায়াতকে সহজ করেছে।
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেশব বাশ্যালের মতে, ভারতের শ্রমবাজারে প্রবেশকারী নতুন নেপালি অভিবাসীরা সাধারণত ১৫-২০ বছর বয়সী হলেও, সামগ্রিক গড় বয়স প্রায় ৩৫। কর্মসংস্থানহীনতা এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বিশেষ করে দরিদ্র, গ্রামীণ ও কম শিক্ষিতদের মধ্যে অভিবাসনের মূল কারণ।
ড. বাশ্যাল বলেন, 'বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবার থেকে আসে। তারা উত্তরাখণ্ডের নির্মাণ ও ধর্মীয় স্থানে, পাঞ্জাবের খামারগুলোতে, গুজরাটের কারখানায় এবং দিল্লি ও এর বাইরে হোটেলগুলোতে কাজ করে।'
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানী জীবন শর্মা বলেন, 'উন্মুক্ত সীমান্তের কারণে ভারতে কর্মরত ও বসবাসকারী নেপালি নাগরিকদের সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন, তবে এটি আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ লাখ হতে পারে।'
নেপালের অর্থনীতি অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নেপালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক-চতুর্থাংশের বেশি অর্থ রেমিট্যান্স থেকে এসেছে। ২০২৪ সালে এটি বেড়ে ২৭–৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশটির ৭০ শতাংশেরও বেশি পরিবার রেমিট্যান্স গ্রহণ করে। তিন দশক আগে যেখানে এটি পারিবারিক আয়ের ২৭ শতাংশ ছিল, এখন তা প্রায় এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে। রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসে উপসাগরীয় দেশ ও মালয়েশিয়া থেকে, যেখানে ভারতের অবদান প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এই নির্ভরশীলতার কারণে নেপাল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেমিট্যান্স-নির্ভর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
তবে, তাদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, ভারতে নেপালি অভিবাসীরা প্রায়শই অনিশ্চিত জীবনযাপন করেন। ২০১৭ সালের মহারাষ্ট্রের একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে, তারা নোংরা ভাগাভাগির রুমে গাদাগাদি করে থাকেন, যেখানে স্বাস্থ্যবিধি অপ্রতুল। কর্মক্ষেত্রে এবং ক্লিনিকগুলোতে প্রায়শই তারা বৈষম্যের শিকার হন। পাশাপাশি তাদের মধ্যে অ্যালকোহল ও তামাক ব্যবহারের হার বেশি এবং যৌন স্বাস্থ্য সচেতনতা কম।
দিল্লির আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, নেপালি অভিবাসীরা 'তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার চেয়ে কেবল মৌলিকভাবে টিকে থাকার জন্য কাজ করছে।'
মুম্বাইয়ের নিরাপত্তা প্রহরী ধনরাজ কাঠায়াতের কথাই ধরা যাক। ১৯৮৮ সালে তরুণ বয়সে কাজের সন্ধানে ভারতে আসা ধনরাজ নাগপুর, বেলগাঁও, গোয়া, নাসিক ঘুরে মুম্বাইয়ে স্থায়ী হন। প্রথমে তিনি গাড়ি চালাতেন, তবে গত ১৬ বছর ধরে ভবন পাহারার কাজ করছেন। এই কাজ কিছু নিরাপত্তা দিলেও তার জীবনে বিশেষ উন্নতি আনতে পারেনি।
ধনরাজ বলেন, 'দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমি খুব বেশি ভাবিনি। নেপালে এত বেশি বেকারত্ব যে, শিক্ষিতরাও কাজ খুঁজে পেতে হিমশিম খায়। সে কারণেই আমার মতো মানুষদের দেশ ছাড়তে হয়েছে।"
তার পরিবার নেপালে থাকে। দুই মেয়ে ও এক ছেলে পড়াশোনা করছে। ভারতে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করা ধনরাজ শুধু নিজের খাবারের ব্যয় এবং বছরে একবার পরিবারের কাছে কিছু টাকা পাঠাতে পারেন। তিনি হতাশার সঙ্গে বলেন, 'এত বছর পর আমার নিজের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। কিছু অভিবাসী হয়তো সমৃদ্ধ হয়েছে—যারা কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা মালয়েশিয়ায় গেছে। আমাদের মতো মানুষেরা নয়।'

ভারতে বসবাসকারী নেপালি অভিবাসীদের রাজনৈতিক দৃশ্যমানতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। প্রায় প্রতিটি প্রধান নেপালি দল ভারতীয় শহরগুলোতে তাদের সিস্টার সংগঠন বজায় রাখে। এই সংগঠনগুলো প্রায়শই স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা প্রবাসীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ, সমর্থন একত্রিত করা এবং নেপালের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ করে।
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানী জীবন শর্মা বলেন, 'ভারতে নেপালি অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের মাতৃভূমিতে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকেন। দরিদ্র ও প্রান্তিক হলেও, তারা নেপালের রাজনীতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজকীয় ক্ষমতা দখলের সময় তাদের প্রভাব বিশেষভাবে স্পষ্ট ছিল, যখন ভারতে নির্বাসিত নেতারা তাদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করেছিলেন।'
তবে, ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাশ্যালসহ অন্যরা এতটা নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, '১৯৯০ সালের আগে, তারা (অভিবাসীরা) মূলত রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় ও আর্থিক সহায়তা দিত; পরে মাওবাদী আন্দোলনের সময় তারা সক্রিয় সমর্থনও দিয়েছিল। বর্তমানে, তাদের রাজনৈতিক প্রভাব খুবই কম। কিছু লোক এখনও ভোট দেওয়ার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে, বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচনের সময়, কিন্তু নীতিগত বিতর্কে তাদের ভূমিকা নগণ্য।'
যদিও অর্থনৈতিক চাপে জর্জরিত অনেক অভিবাসী শ্রমিকের বিপরীতে, ভারতে অধ্যয়নরত নেপালি শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যত নিয়ে আরও স্পষ্টভাষী, নিযুক্ত এবং আশাবাদী।
দিল্লি-ভিত্তিক শিক্ষার্থী অনন্ত মাহাতো জানান, নেপালে থাকলে তিনিও আন্দোলনে যোগ দিতেন। তার মতে, 'সংবিধানই সর্বোচ্চ।' নেতৃত্বের শূন্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তিনি বিশ্বাস করেন, এখন সময় এসেছে 'পুনর্গঠনের'। অন্য শিক্ষার্থী আভা পরাজুলী জানান, 'নেপালে থাকলে আমি বন্ধুদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিতাম, যদিও আমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংসের সমর্থন করি না। আমরা একজন ভালো নেতার উত্থানের আশা করি।'
বিশ্লেষকরা মনে করেন, কাঠমান্ডুতে প্রতিবার অস্থিরতা বাড়লে ভারতে অভিবাসনের স্রোতও বাড়ে, যা তরুণদের ভারতের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির দিকে ঠেলে দেয়। সেখানে সুরক্ষা খুব কম এবং কাজের সুযোগও অনিশ্চিত। বর্তমানে, অনেকেই এই অস্থিরতার মধ্যে নিজ দেশে ফিরছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদে যদি এই অস্থিতিশীলতা আরও গভীর হয়, তবে আরও বেশি সংখ্যক নেপালি কাজের সন্ধানে আবারও দেশ ছেড়ে পালাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ভারতের এমনিতেই ভারাক্রান্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারকে আরও স্ফীত করবে।
অধ্যাপক বাশ্যালের মতে, 'এই ধরনের রাজনৈতিক সংকট নেপালে তরুণদের [বেকারত্বের] সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলে। নিশ্চিতভাবেই, ভারতে নেপালি অভিবাসীর সংখ্যা বাড়বে। একই সাথে, ভারতে সঠিক কর্মসংস্থান পাওয়া সহজ নয়।'