সীতা রাম: এক অচেনা বাঙালি শিল্পী যিনি ব্রিটিশদের জন্য ছবি আঁকতেন

লক্ষ্ণৌর বড় ইমামবাড়ার সামনের খোলা চত্বর। বাঁদিকে ইমামবাড়ায় প্রবেশের সুউচ্চ ফটক। পেছনে অবশ্য ইমামবাড়ার মূল ভবন দেখা যাচ্ছে না। কারণ ফটক দিয়ে প্রবেশের পর দুটো বড় চত্বর পেরিয়ে তবেই মূল ভবনে পৌঁছানো যায়। গেটের পাশে একটু সামনেই রুমি দরওয়াজা — পুরোনো লক্ষ্ণৌয় প্রবেশদ্বার। সামনের চত্বরে একটা হাতি, ঘোড়া, আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষ।
এ বর্ণনাটা একটা ছবির। ছবিটি এঁকেছেন সীতা রাম। তবে তার আগে ইমামবাড়া নিয়ে আরও কিছু তথ্য জানা যাক। ১৭৮৪ সালে এ মঞ্জিলটি তৈরি করা হয়েছিল দুর্ভিক্ষের ত্রাণকাজ পরিচালনার প্রকল্প হিসেবে। আউধের নবাব পরিবারের নবাব আসাফ-উদ-দৌলা নির্মাণ করেন ইমামবাড়া। মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত ভারতবর্ষের শেষ ভবনগুলোর একটি এটি।
সীতা রাম ইমামবাড়ার সামনের চত্বরের ছবিটি এঁকেছেন জলরংয়ে। দারুণ প্রতিভাধর ভারতীয় এ চিত্রশিল্পীর পরিচয় দীর্ঘদিন অজানা ছিল। তার আঁকা ইমামবাড়ার এ ছবিটি এ মাসের শেষে ভারতের দিল্লিতে একটি প্রদর্শনীতে দেখানো হবে।
১৮১৪ সালে জুন থেকে ১৮১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ফ্রান্সিস রডনের সঙ্গে সীতা রাম ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। মার্কেস অভ হেস্টিংস নামেও পরিচিত রডন ১৮১৩ সালে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরের এক দশক ওই পদে বহাল ছিলেন তিনি (বলে রাখা ভালো, এই মার্কেস অভ হেস্টিংস আর ভারতবর্ষের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কিন্তু আলাদা ব্যক্তি)।
শিল্প ইতিহাসবিদদের মতে, লর্ড হেস্টিংস প্রায় ২২০টি নৌকা ও বিশাল এক সফরসঙ্গী নিয়ে ভারতবর্ষে দীর্ঘ ১৫ মাসের নৌভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তার সঙ্গেই ছিলেন সীতা রাম, যাকে হেস্টিংস কেবল 'বেঙ্গল ড্রাফটম্যান' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার এ যাত্রা শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকে, তিনি গিয়েছিলেন হরিয়ানার ঝিন্দ পর্যন্ত।

আর্ট হিস্টোরিয়ান গিলস টিলোটসনের মতে, হেস্টিংসের এ দীর্ঘ ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল 'উত্তর ভারতের শাসকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, যাতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে ভারতবর্ষে আরেকটু বাড়ানো যায়, এবং নেপালে চলমান যুদ্ধকে আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা'।
এ ভ্রমণে সীতা রাম জলরংয়ের ২২৯টি বড় ছবি আঁকেন। যাত্রাপথে যেসব ভবন আর প্রাকৃতিক দৃশ্য তার ভালো লেগেছিল, সেগুলোই পটে ধরে রেখেছিলেন তিনি। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরির সাবেক কিউরেটর জেপি লসটি লিখেছিলেন, 'নদীযাত্রার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা কয়েকটি ছবি ভারতবর্ষের চিত্রশিল্পের সবচেয়ে সুন্দর ও স্নিগ্ধ নির্মাণ'।
সীতা রামের আঁকা ছবিগুলো গড়ে ৪০ বাই ৬০ সেন্টিমিটার। মোট ১০টি অ্যালবামে ছবিগুলো এঁকেছিলেন তিনি। হেস্টিংস দেশে ফেরার সময় ছবিগুলো সঙ্গে নিয়ে যান। পর্যায়ক্রমে ছবির মালিকানা হাতবদল হয় তার উত্তরসূরীদের মধ্যে — ১৮২০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর ধরে। সেজন্যই দীর্ঘসময় ধরে সীতা রামের এসব কীর্তি মানুষের অজানা ছিল।
১৯৭৪ সালে হেস্টিংসের পরিবার ৪৬টি ছবিসমৃদ্ধ দুটো অ্যালবাম লন্ডনে সদবি'র এক নিলামে বিক্রি করে। অ্যালবামগুলোতে সীতা রামের নাম স্বাক্ষর করা ছিল। তখন মানুষ সীতা রামের কাজ নিয়ে বিস্তৃতভাবে জানতে পারে।
টিলোটসনের মতে, কেবল ওই দুটো অ্যালবামের কাজ দেখেই ভারতীয় চিত্রকর্ম বিশারদেরা সীতা রামকে ওই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় শিল্পী হিসেবে অভিধা দেন। তবে ছবিগুলোর মালিকানার তথ্য গোপন রেখে নিলামে তোলা হয়েছিল, তাই হেস্টিংসের সঙ্গে সীতা রামের কোনো যোগসূত্র তখন বের করা যায়নি।
বিশ বছর পরে হেস্টিংসের পরিবার বাকি আটটি অ্যালবাম এবং পরে আঁকা ছবির আরও তিনটি অ্যালবাম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। পরের ছবিগুলো সীতা রাম ১৮১৭ ও ১৮২১ সালে বাংলা ভ্রমণের সময় এঁকেছিলেন। এ সংগ্রহ ব্রিটিশ লাইব্রেরি কিনে নেয়।

'দেখা গেল, সীতা রামের পৃষ্ঠপোষক কেবল হেস্টিংসই ছিলেন না। তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করার পর সীতা রাম অন্য ব্রিটিশ হোমরাচোমরাদের জন্য ছবি আঁকেন। এছাড়া ব্রিটিশদের জন্য আঁকা অনেক ছবিরই ভিন্ন সংস্করণ এঁকেছিলেন সীতা রাম — কখনো নিজের কাছে রাখতে, আবার কখনো বিক্রি করতে,' বলেন টিলোটসন।
সীতা রামের কাজ ছিল 'কোম্পানি পেইন্টিংস' নামক জঁরার। এ জঁরাটির স্বাতন্ত্র্য এর জলরং ও কাগজের ব্যবহারে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পর স্থানীয় অনেক শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকিয়েছিল। এসব শিল্পীরা আগে মোগলদের জন্য ছবি আঁকতেন। এ তালিকায় আছেন পাটনার সেবক রাম, দিল্লির গোলাম আলি খানের মতো প্রখ্যাত শিল্পীরা।
বাঙালি চিত্রশিল্পী সীতা রামকে নিয়ে তেমন বেশি কিছু জানা যায়না। ধারণা করা হয়, মুর্শিদাবাদের মোগল স্কুলে তিনি প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। 'স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে সীতা রামের মতো শিল্পীরা ব্রিটিশ শাসনের সময় গড়ে ওঠা নতুন নতুন শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন নিজেদের কাজের পৃষ্ঠপোষক খুঁজতে,' বলেন টিলোটসন।
সীতা রাম কি কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ড্রাফটম্যান ছিলেন? লসটি তা-ই মনে করতেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, সীতা রামের আঁকা ছবিতে ড্রাফটম্যানশিপের একটি শৈলী ছিল। টিলোটসনের মতে, ১৯ শতকের শুরুতে ইউরোপীয় পৃষ্ঠপোষকদের জন্য কাজ করা সবচেয়ে বহুমুখী ও উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন শিল্পীদের একজন ছিলেন সীতা রাম।