ভ্যান গখের 'সানফ্লাওয়ারস'-এর রহস্যময় বার্তা! কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি?

ভিনসেন্ট ভ্যান গখ,চিত্রকলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তার নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে একগুচ্ছ উজ্জ্বল হলুদ সূর্যমুখী। প্রতিবেদন বিবিসির।
এই ফুলের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অদ্ভুত রকমের গভীর। একবার তিনি লিখেছিলেন, "দ্য সানফ্লাওয়ার ইজ মাইন।" এই আগুনরঙা ফুল যেন তার পরিচয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে,এই সূর্যমুখী দিয়ে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন?
লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে রাখা 'সানফ্লাওয়ার' চিত্রকর্মটি ছাড়াও তিনি মোট ১১টি ছবিতে এই ফুলকে তুলে এনেছেন।
প্রথম চারটি প্যারিসে, ১৮৮৭ সালে। এরপর ফ্রান্সের আরল শহরে গিয়ে ১৮৮৮ সালে মাত্র এক সপ্তাহে আঁকলেন আরও চারটি। ১৮৮৯ সালের শুরুতে আগের কয়েকটি চিত্রের অনুলিপি করলেন।
সবচেয়ে বিখ্যাত যেসব চিত্র, সেগুলো তিনি এঁকেছিলেন প্রবল তৃপ্তি নিয়ে। তিনি নিজেই বলেছিলেন, "একজন মার্সেইবাসী যেমন তৃপ্তি নিয়ে বুইয়াবেস (ফ্রান্সের মার্সেইয়ের বিখ্যাত খাবার) খায়, আমি সেভাবেই এঁকেছি।"
তবে তিনি কখনও স্পষ্ট করে বলেননি, সূর্যমুখী তার কাছে কী অর্থ বহন করে।
একদিকে মনে হয়, রঙের ব্যবহার,বিশেষ করে হলুদের নানা ছায়া,নিয়ে পরীক্ষা করাই ছিল উদ্দেশ্য।

অন্যদিকে,মনে হয় এগুলো আঁকা হয়েছিল তার বাড়িতে পল গগাঁ নামের এক সহশিল্পীর আগমন উপলক্ষে। গগাঁ তার আগের সূর্যমুখী চিত্রের প্রশংসা করেছিলেন। তাই হয়তো এই ফুলের ছবি বন্ধুত্ব ও সঙ্গীসত্তার প্রতীক ছিল।
কিন্তু সে আশা পূর্ণ হয়নি। গগাঁ মাত্র দুই মাসে চলে যান। আর ভ্যান গখও নিজের জীবদ্দশায় তেমন স্বীকৃতি পাননি। মারা যান মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।
তবে মৃত্যুর পরই শুরু হয় তার খ্যাতির উত্থান।
বিশ শতকের শুরুতে ইউরোপের শিল্পীদের মধ্যে তার সূর্যমুখীচিত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালে লেখিকা ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড বলেন, "হলুদ সূর্যমুখী আমার সৃষ্টিশীলতাকে জাগিয়ে তুলেছিল।"
১৯২৩ সালে সমালোচক রজার ফ্রাই বলেন, "ভ্যান গখের সূর্যমুখী ছবিগুলো প্রাণশক্তি, আবেগ এবং সাহসের প্রতীক।"
এখন ২১ শতকেও ভ্যান গখের প্রভাব স্পষ্ট। রয়াল একাডেমিতে আয়োজিত একটি প্রদর্শনী কিফার /ভ্যান গগ-এ গুরুত্ব পেয়েছে সূর্যমুখীই।
এই প্রদর্শনীতে জার্মান শিল্পী আনসেলম কিফারের একটি ভাস্কর্য দেখানো হয়েছে, যেখানে বইয়ের স্তূপ থেকে জন্ম নিচ্ছে সূর্যমুখী।
আরও রয়েছে কাঠে খোদাই করা চিত্রকর্ম, যেখানে একটি মৃতদেহের শরীর থেকে বেরিয়ে এসেছে সূর্যমুখী।
প্রদর্শনীর কিউরেটর জুলিয়ান ডমের্ক বলেন, "ভ্যান গখের কাছে সূর্যমুখী ছিল দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রতীক।"
তরুণ বয়সে ভ্যান গখ ছিলেন চিত্রবিক্রেতা। শিল্পের ইতিহাস নিয়ে তার জ্ঞান ছিল গভীর।
তিনি সূর্যমুখী এঁকেছেন ডাচ ঐতিহ্যের ধারা মেনে, কিছু ফুল এখনো সূর্যের দিকে তাকানো, কিছু ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে। এতে তিনি যেন সময়ের অস্থায়িত্ব নিয়ে ভাবছিলেন।
ডমের্ক মনে করেন, কিফারও একই ভাবনায় সূর্যমুখী ব্যবহার করেছেন যেখানে এটি বোঝায় জীবনের চক্র, নতুন থেকে পুরাতনে যাওয়ার ছন্দ।
ইতিহাসে সূর্যমুখীর প্রতীকী অর্থ
শিল্পে সূর্যমুখীর ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক পরে। এই ফুল আমেরিকার জন্মভূমি, ইউরোপে এসেছে কলম্বাসের অভিযানের পর।
এই ফুলের সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য,সূর্যের দিকে মুখ ঘোরানো। এই বৈশিষ্ট্যই একে প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছে।
১৫৬৮ সালে ইতালীয় উদ্ভিদতত্ত্ববিদ কোর্তুসো সূর্যমুখীকে প্রাচীন গ্রিক মিথের ক্লাইটি চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেন।
ক্লাইটি সূর্যদেব অ্যাপোলোর প্রেমে পড়েছিলেন। দিনের পর দিন তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে ফুল হয়ে যান,সূর্যমুখী।
এরপর থেকেই সূর্যমুখী হয়ে ওঠে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আত্মনিবেদনের প্রতীক।
১৭ শতকে মারিয়া ভ্যান উস্টারউইকের চিত্রে সূর্যমুখী দেখা যায়।
১৬৭০ সালের চিত্রকর্ম 'ইয়াং ওম্যান হোল্ডিং অ্যা সানফ্লাওয়ার'-এ, নারীর হাতে থাকা সূর্যমুখী ফুলটি সম্ভবত তার সাংসারিক জীবনের নিষ্ঠতার প্রতীক।
ধর্মীয় চিত্রেও এসেছে এই ফুল।

ভ্যান ডাইকের 'রেস্ট অন দ্য ফ্লাইট ইনটু ইজিপ্ট' ছবিতে ভার্জিন মেরির মাথার ওপরে সূর্যমুখী রয়েছে,আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে সংযোগের প্রতীক।
১৬৫৪ সালে ডাচ কবি ভন্ডেল বলেন, "যেমন সূর্যমুখী সূর্যের দিকে ঝোঁকে, তেমনি চিত্রকলাও প্রকৃতির সৌন্দর্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে।"
ভ্যান ডাইকের আত্মপ্রতিকৃতিতে সূর্যমুখীকে নিজের শিল্পীসত্তার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
আধুনিক রাজনীতিতেও সূর্যমুখী এসেছে।
চীনা শিল্পী আই ওয়েইওয়েইয়ের 'সানফ্লাওয়ার সিডস' ইনস্টলেশনে দেখা যায় ১০ কোটি সূর্যমুখী বীজ,যা চীনের চেয়ারম্যান মাওয়ের সময়কার পোস্টারের অনুপ্রেরণায় তৈরি।
সেই পোস্টারগুলোয় মাওকে সূর্যের মতো দেখানো হতো, আর জনগণ সূর্যমুখীর মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকত।
মানব-চেতনার প্রতীক সূর্যমুখী
সব মিলিয়ে সূর্যমুখীর প্রতীকী অর্থ,বিশ্বাস, আনুগত্য আর নির্ভরতা।
ভ্যান গখ হয়তো এ সবকিছুর কথা ভেবেই লিখেছিলেন,"আমার এই ছবিগুলো যেন কষ্টের চিৎকার, আবার এক ধরনের কৃতজ্ঞতাও আছে।"
আনসেলম কিফার সূর্যমুখী নিয়ে বলেন, "সূর্যমুখী সূর্যের পেছনে ঘোরে। ফুল ফোটার মুহূর্তই যেন তার মৃত্যুর শুরু।"
তার শিল্পকর্মে সূর্যমুখী অনেক সময় শুকিয়ে যায়, কালচে হয়। কিন্তু সেখানেই আবার বীজ ঝরে পড়ে,নতুন জীবনের আশা তৈরি হয়।
কিফার অনুপ্রাণিত হয়েছেন ১৭ শতকের চিকিৎসক ও দার্শনিক রবার্ট ফ্লাডের চিন্তা থেকে।
ফ্লাড বিশ্বাস করতেন, গাছপালা, মানুষ আর আকাশ,সব একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত।
এই যুক্তি থেকেই কিফার তার ছবিতে দেখান,সূর্যমুখী কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, কখনো মানুষের শরীর থেকে জন্ম নেয়।
এ যেন জানিয়ে দেয়,এই ফুল আমাদের জীবনের সঙ্গে আকাশের, চেতনার সঙ্গে অনন্তের, দেহের সঙ্গে আত্মার সংযোগ তৈরি করে।
ভ্যান গখের সূর্যমুখী শুধু শিল্প নয়, বরং প্রেম, ধর্ম, বন্ধুত্ব, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যকার জটিল টানাপড়েনের প্রতীক। আজও এই ফুল আমাদের মনে করিয়ে দেয়,জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আলোর প্রতি, সৌন্দর্যের প্রতি, ভালোবাসার প্রতি আমাদের আকর্ষণ চিরন্তন।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা