ওয়াগনারকে অবশ্যই রাশিয়ার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হবে: পুতিন

গত জুন মাসে ব্যর্থ বিদ্রোহ ও সম্প্রতি বস ইয়েভগেনি প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমান বিধ্বস্তের পর ওয়াগনার গ্রুপের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এরই মাঝে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সকল ওয়াগনার সেনা ও অন্য রুশ প্রাইভেট মিলিটারি গ্রুপকে রাশিয়ার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। খবর বিবিসির।
গত শুক্রবার (২৫ আগস্ট) প্রেসিডেন্ট পুতিন এ সংক্রান্ত একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছেন। ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ হওয়া ডিক্রিটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে ইউক্রেনের সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, সেনাবাহিনীকে সহায়তা কিংবা আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা ইউনিটে কাজ করা সকলের ক্ষেত্রে ডিক্রিটি প্রযোজ্য হবে।
গত বুধবার মস্কোর উত্তরে তেভর অঞ্চলে একটি প্রাইভেট জেট বিধ্বস্ত হয়ে বিমানটিতে থাকা ১০ জনের সকলেই নিহত হয়েছেন। দেশটির অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ রোজাভিয়াসিয়ার তথ্যমতে, ঐ বিমানে থাকা যাত্রী তালিকায় ওয়াগনার বস ইয়েভগিনি প্রিগোজিনের নামও ছিল। তারই মাত্র দুইদিন পর তাৎপর্যপূর্ণ ডিক্রিটি জারি করলেন পুতিন।
অন্যদিকে গতকাল (শনিবার) রুসিচ নামের ওয়ানারের অতি-ডানপন্থী সাবইউনিট জানায়, তারা ইউক্রেনে সামরিক অভিযান বন্ধ করে দিচ্ছে।
কেননা টেলিগ্রাম পোস্টে সাব-ইউনিটটি অভিযোগ জানায় যে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইয়ান পেট্রোভস্কির নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত পেট্রোভস্কিকে ভিসা লঙ্ঘনের অভিযোগে ফিনল্যান্ডে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত জুন মাসে ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের পর বেশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন পুতিন। আর তাই তিনি এই ডিক্রি জারি করে বাহিনীটির ওপর তিনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।
এ সম্পর্কে লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের নাটিয়া সেসকুরিয়া বলেন, "পুতিন ওয়াগনার গ্রুপের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। যাতে তিনি ভবিষ্যতে আর কোনো সংকটের মুখোমুখি না হন।"
প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্তের ঘটনায় ওয়াগনার গ্রুপে এখন নেতৃত্বের সংকট দেখা দিয়েছে। ওই বিমানে প্রিগোজিন ছাড়াও তার প্রধান সহচর দিমিত্রি ইউতকিন ছিলেন।
এমতবস্থায় জারি করা ডিক্রিটিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে একটি নৈতিক ভিত্তি তৈরির পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও শপথে কমান্ডারদের আদেশ কঠোরভাবে অনুসরণ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
এ সম্পর্কে ইউক্রেনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ডেমোক্র্যাটিক ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশনের প্রধান পেট্রো বুরকোভস্কি বলেন, "ডিক্রিটি ওয়াগনার যোদ্ধাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য রুশ সামরিক গোয়েন্দাদের কাছে দেওয়া একটি গোপন বার্তা।"
পেট্রো বুরকোভস্কি মনে করেন, ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ সেনাদের প্রতিও ডিক্রিটি একটি স্পষ্ট বার্তা। ডিক্রিটি বিশ্লেষণে তিনি বলেন, "শপথ নিন এবং নিজের কাছে অস্ত্র রাখুন। নতুবা নিজেকে নিরস্ত্র করুন। রুশ প্রশাসনকে মানতে হবে নতুবা জেলে যেতে হবে।"
এদিকে রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী গতকাল (শনিবার) সকালে মস্কো ও বেলগোরোড অঞ্চলে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা প্রতিরোধের দাবি করেছে। সেই সঙ্গে ইউক্রেন সীমান্তবর্তী দেশটির বেলগোরোড অঞ্চলে গোলাবর্ষণে কয়েকজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় গভর্নর।
ইউক্রেন সরকার অবশ্য রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালানোর কথা প্রকাশ্যে কখনোই স্বীকার করে না। অন্যদিকে ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর কুপিয়ানস্কের কাছে একটি ইউক্রেনীয় গ্রামে রুশ গোলাবর্ষণে দুজন নিহত এবং একজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন খারকিভের আঞ্চলিক গভর্নর।
গত জুন মাসে প্রিগোজিনের ব্যর্থ বিদ্রোহের কয়েক সপ্তাহ আগেই ঘটেছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১ জুলাই পর্যন্ত ওয়াগনার গ্রুপকে সেনাবাহিনীর চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সময় বেধে দিয়েছিল। কিন্তু ওয়াগনার বস ঐ চুক্তি স্বাক্ষরে অপরাগতা প্রকাশ করে।
কেননা প্রিগোজিন চাইতেন না যে, ওয়াগনার সেনারা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হোক। এক্ষেত্রে পুতিন মন্ত্রণালয়ের চুক্তির পরিকল্পনাকেই সমর্থন দিয়েছিলেন। যার ফলে তার দীর্ঘদিনের মিত্র প্রিগোজিনের সাথে রুশ প্রেসিডেন্টের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আর এর কিছুদিন পরেই প্রিগোজিনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় ব্যর্থ বিদ্রোহ।
কিন্তু একজন সর্বোচ্চ নেতা ছাড়া ওয়াগনার যোদ্ধাদের উপর ডিক্রিটি ঠিক কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। পেট্রো বুরকোভস্কি মনে করেন, ওয়াগনার সেনারা অভিজ্ঞ যোদ্ধা। তাই তারা রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
পেট্রো বুরকোভস্কি বলেন, "রুশ প্রশাসন যুদ্ধের জন্য ওয়াগনারকে বেছে নিয়েছিল কেননা গ্রুপ্তি দেশটির সেনাবাহিনীতে বিদ্যমান আমলাতন্ত্র ছাড়াই বিশেষ সুবিধা প্রদানে সক্ষম ছিল। এখন গ্রুপ্তির সেনারা যদি পুতিনের নির্দেশে বিশেষ সুবিধা পায়, তবে আমি মনে করি তারা কোথায়, কার সাথে এবং কার জন্য লড়াই করবে সেটা নিয়ে চিন্তা করবে না।"
অন্যদিকে নাটিয়া সেসকুরিয়া মনে করেন, পুতিনের জারি করা ডিক্রিটি হয়তো অল্প সময়ের জন্য কার্যকরী হবে। তবে ওয়াগনার সেনারা সকলেই প্রিগোজিনের সমর্থক। তাই তারা ডিক্রি অনুযায়ী শপথ নেবে না।
নাটিয়া সেসকুরিয়া বলেন, "এটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে পুতিনের জন্য সম্ভবত সমস্যা তৈরি করতে পারে।"
গত জুলাই মাসে বিদ্রোহের পর থেকে নিজেকে অনেকটা আড়ালেই রেখেছিলেন প্রিগোজিন। মাত্র ২৪ ঘণ্টা টিকে থাকা বিদ্রোহে গ্রুপটি দক্ষিণ রাশিয়ার শহর রোস্তভে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও পরবর্তীতে বেলারুশের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় বিদ্রোহ থেকে সরে এসেছিল ওয়াগনার গ্রুপ।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে অংশ নিয়েছিল ওয়াগনার গ্রুপ। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই অস্ত্র সরবরাহে ঘাটতির অভিযোগ তুলে রাশিয়ার সামরিক নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন ওয়াগনার বস প্রিগোজিন। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক-প্রধানের সঙ্গেও প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তারই চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
অন্যদিকে প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পেছেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, '(রাশিয়ায়) কী ঘটেছে, তা আমি জানি না। তবে আমি আশ্চর্য হইনি। রাশিয়ায় এমন কিছু ঘটে না, যেখানে পুতিনের হাত নেই।'