তালা-চাবির আশ্চর্য জাদুকরদের গল্প

বয়স আশির আশেপাশে মোসলেম উদ্দিনের। পরনে জীর্ণ একখানি জামা আর রং ওঠা লুঙ্গি। চোখে ছানির পরত, তাই দৃষ্টি অনেকটাই ঝাপসা। ঝাপসা চোখে মোসলেম চেয়ে থাকেন খরিদ্দারের আশায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ নম্বর গেটসংলগ্ন রাস্তায় সারি সারি ছাতা বিছানো। প্রত্যেকের সামনে একটি ছোটখাটো কাঠের বাক্স, সেটার ওপর বিছানো সুতি কাপড়। তাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কিছু যন্ত্রপাতি, ধারালো সরঞ্জাম, টুকরো টুকরো ইস্পাত আর তামার পাত। ফুটপাতের ধারে তল্পিতল্পা বিছিয়ে ৭-৮ জন কারিগর চাবি বানানোর কাজ করেন।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ মোসলেম উদ্দিন। পাকিস্তান আমল থেকে তালা-চাবির সঙ্গে সখ্য তার। ৬০ বছর ধরে বানিয়ে চলেছেন চাবি। কখনো তালার গন্ডগোলে ডাক পড়েছে গেরস্থ বাড়ির দুয়ারে, কখনো তালা-চাবি সমেত হাজির হয়েছেন বাড়ির কর্তা নিজেই। রকমারি তালা-চাবি দেখেছেন এ প্রবীণ কারিগর।
এখন চোখের সমস্যার কারণে খুব বেশি কাজ করতে পারেন না। বয়সের কারণে কাজের গতিও ধীর হয়ে গেছে। এজন্য ৭-৮ জন কারিগরের মধ্যে সব থেকে কম কাজ পান তিনি।
ষাটের দশকে মোসলেম উদ্দিনের বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর। তার বাবা ছিলেন চাবির কারিগর। মোসলেম স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। তাই বাবার সঙ্গে বসতেন চাবির দোকানে।
তখন ঠিক দোকান বলতে যা বোঝায় তা ছিল না—চটের ছালা বিছিয়ে বসতেন মোসলেমের বাবা। মোসলেম হাতে-হাতে এটা-সেটা এগিয়ে দিতেন, খরিদ্দারদের খেয়াল করতেন। তবে মনটা আটকে থাকত নাটাই আর ঘুড়ির ডানায়।
অভাব বড় বালাই। পাঁচ বোন, দুই ভাই আর বাবা-মায়ের সংসারে বাবা ছিলেন একমাত্র রোজগেরে মানুষ। মোসলেম বড় ছেলে। ছেলেমানুষী ছেড়ে পেটের জ্বালায় চাবি তৈরির সূক্ষ্মতম কাজ আস্তে আস্তে শিখতে লাগলেন।
নকশায় সামান্যতম ত্রুটি একটি চাবিকে করে তুলত অকেজো। তাই হুবহু করে তোলার কারসাজি শেখা মোটেও সহজ ছিল না। তখন একেকটা চাবি তৈরি করে মিলত দুই আনা। দুই আনার তখন দামও ছিল অবশ্য।
এখন যেখানে মোসলেম উদ্দিন বসেন, তার ঠিক বিপরীতে বসতেন তার বাবা। আস্তে আস্তে তালা-চাবির সঙ্গে সখ্য বাড়তে থাকে। সেই সখ্য রয়ে গেছে আজও।
বাবা আর তিনি মিলে কাজ করে পাঁচ বোনের বিয়ে দিয়েছেন। একে একে বাবা-মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ভাইয়েরা ব্যবসা শুরু করেছেন। কিন্তু মোসলেম তালা-চাবির এই জুড়িকে ছাড়তে পারেননি—অনেকটা মায়া, অনেকটা দক্ষতা।

অন্য কিছু করতে গেলে নতুন করে কাজ শেখার ঝক্কি। তাই পৈতৃক পেশাকে ধরে রেখেছেন তিনি। অনেককে হাতে ধরে কাজও শিখিয়েছেন। এখন মোসলেম বলতে গেলে বাদের খাতায়। সঙ্গীদের তুলনায় তার কাছে কাজ অনেকটাই কম।
তবু তিনি এতদিনের পুরোনো জায়গাটা ছেড়ে থাকতে পারেন না। প্রতিদিন দোকান খুলে বসেন। দু-চারটে চাবি তৈরি করেন। আয় দৈনিক ২০০-৩০০ টাকার বেশি হয় না। তবু বসে থাকার চেয়ে তো ভালো।
মোসলেমের হাত ধরে কাজ শিখেছেন তার ছেলে। ছেলে এখন গুলিস্তানে ফেরি করে চাবির নকল তৈরি করেন, তালার কলকব্জা সারিয়ে তোলেন হাতের ছোঁয়ায়। যতই হোক, তিন পুরুষের কাজ। দক্ষতার পাশাপাশি রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্যও।
চাবি বানাতে আসা একজন কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিগত ১০ বছর ধরে তিনি এখানে চাবির সমস্যা নিয়ে আসেন। কখনো চাবির ডুপ্লিকেট বানাতে, আবার কখনো বাসাবাড়ির দরজার তালা আটকে গেলে মোসলেম উদ্দিনকেই ডেকে নিয়ে যান। তিনি বলেন, "মোসলেম উদ্দিন হচ্ছেন আমার বিপদের বন্ধু।"
এই গ্রাহক জানান, তার ভুলো মনের জন্য অনেকবারই ঘরের মধ্যে চাবি রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে আসেন। এরপরই বাধে বিপত্তি। তখনই ডাক পড়ে মোসলেম উদ্দিনের। সুনিপুণ হাতে মাত্র ৭-৮ মিনিটের মধ্যেই তালা খুলে ফেলেন তিনি—যেন তালা-চাবির জাদুকর। ঠিক এভাবেই দশ বছর ধরে আরমান সাহেবের সঙ্গে মোসলেম উদ্দিনের এক ভরসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় তার চাবি কবিতায় লিখেছেন—
'আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরংগ আজ খোলো?'
তোরংগ খুলতে তখন দ্বারস্থ হতে হয় চাবির ডাক্তারের কাছে—যিনি শুধু চাবি বানান না, হারিয়ে যাওয়া চাবির ছবি কিংবা নকশা দেখে তৈরি করে দেন নতুন চাবি। তালা-চাবির মতো জিনিস আমাদের জীবনে অতি প্রয়োজনীয় বললে ভুল বলা হবে না।
বাংলা সাহিত্যে জমিদারবাড়ির গিন্নিকে আঁচলে বাঁধা এক গোছা চাবি ছাড়া যেন কল্পনাই করা যায় না। অর্থাৎ, চাবি অনেকখানি দায়িত্ব আর কর্তৃত্বের প্রতীকও বটে। রবীন্দ্রনাথের 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি' গানে অবশ্য চাবিকে ঠিক তালা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে কি না—তা নিয়ে রয়েছে নানা মত।
নিত্যদিন মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল থেকে শুরু করে অফিস কিংবা বাসার আলমারি, শোকেস, ড্রয়ার, ব্যক্তিগত রুমের দরজা, বাড়ির মূল ফটক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কলাপসিবল গেটে—নিরাপত্তার স্বার্থে তালা ঝোলাতে হয়। তাই তালা-চাবি সংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় পড়লে আমাদের সবারই কমবেশি ছুটতে হয় কারিগরদের কাছে।
রাস্তার ধারে ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে একটুখানি জায়গা খুঁজে এসব মানুষ চাবি তৈরি করেন, ঠিকঠাক করে সারিয়ে তোলেন তালার গলদ। হয়তো ব্যস্ততম দিনে জ্যামে বসে আমরা তাদের দিকে একবার ফিরেও তাকাই না। কিন্তু দরকার পড়লে এই মানুষগুলোই হয়ে ওঠেন মুশকিল আসান।
এরা আদ্যোপান্ত শিল্পীই বটে—সামান্য টাকার বিনিময়ে সূক্ষ্মতম নকশার চাবি বানিয়ে দেন হাতের সুনিপুণ কৌশলে। অনেক সময় চাবি হারিয়ে গেলেও শুধু তালা নিয়ে এলেই চাবি বানিয়ে ফেলা যায়, যদিও তখন সময় একটু বেশি লাগে।

বিশ্বের প্রাচীনতম চাবির সন্ধান পাওয়া যায় মিশরে। প্রায় চার হাজার বছর আগে তৈরি কাঠের তালা-চাবির সেই লক সিস্টেম ছিল ত্রুটিপূর্ণ—যেকোনো ছবি দিয়ে যেকোনো তালা খোলার সুযোগ ছিল।
পরবর্তীতে সভ্যতার বিবর্তন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তালা-চাবির নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। রোমান ও গ্রিকরা তালা-চাবির উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তবে আমরা বর্তমানে যে তালা-চাবি ব্যবহার করি, তার উদ্ভব আঠারো শতকে।
আমেরিকান লিনাস ইয়েল এবং তার ছেলে স্প্রিংচালিত পিন টাম্বলার লক তৈরি করেছিলেন। সাধারণত যে তালা চোরেরা সহজে খুলতে পারত না কিংবা একেবারেই খুলতে পারত না, সেই তালাকে তত ভালো বলে ধরা হত। ইংল্যান্ডের রবার্ট ব্যারোন দু'ভাবে কাজ করা টাম্বলার লক আবিষ্কার করেন।
এছাড়া জোসেফ ব্রামাহ ১৭৮৪ সালে এমন একটি তালা তৈরি করেন, যেটি পরবর্তী ৬৭ বছর পর্যন্ত কোনো চোরই ভাঙতে সক্ষম হয়নি। জেরেমিয়াহ চাব ১৮১৮ সালে ডিটেক্টর লক তৈরি করেন। ১৮৪৮ সালে আমেরিকার লিনাস ইয়েল বর্তমানে ব্যবহৃত পিন টাম্বলার তালা আবিষ্কার করেন।
এই আবিষ্কারকের ছিল একটি তালা-চাবির দোকান। তার ছেলে লিনাস ইয়েল ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। বাবার চাপে পোর্ট্রেট আঁকা ছেড়ে পৈতৃক ব্যবসায় ঢোকার পর, তিনি আঁকার প্রতিভাকে তালা-চাবি উন্নত করার কাজে ব্যবহার করেন। বাবার তৈরি পিন টাম্বলার ডিজাইনকে আরও আধুনিক করে তোলেন শিল্পীসত্তা ও বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে। তার তালার ডিজাইন এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেমস সার্জেন্ট ১৮৫৭ ও ১৮৭৩ সালে কম্বিনেশন তালা এবং দুটি চাবি দিয়ে খোলা তালা আবিষ্কার করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে তালার সাইজ ছিল প্রকাণ্ড, আর চাবিও ছিল তুলনামূলক বড়। লোহার পাতের শেষ প্রান্তে খাঁজ কেটে তৈরি হতো সেসব চাবি।
সত্তর ও আশির দশক থেকে টিপ তালা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এ ধরনের তালার আকার কিছুটা ছোট ছিল। পাশাপাশি তালা দেওয়ার জন্য চাবির প্রয়োজন পড়ত না—শুধু খোলার কাজেই চাবির ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল।
ইদানিং এক ধরনের প্যাঁচের তালা ছড়িয়ে পড়ছে, যেগুলোতে তালা দেওয়া ও খোলা—দুই ক্ষেত্রেই চাবির ভূমিকা রয়েছে। এই তালায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলনামূলক উন্নত, তাই টিপ তালা এখন অনেকটাই আলোচনার বাইরে।
তালা-চাবির কারিগরদের পেশায় চ্যালেঞ্জ আসে তালার মডেল বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ভিন্ন ধরনের চাবির জন্য শিখতে হয় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল। তালার কলকব্জা সারতেও আনতে হয় নতুনত্ব। তবে যারা তালা-চাবির ডাক্তার, তাদের কাছে এসব ডালভাতই বটে—দু-চারদিন ঘাটাঘাটি করলেই নতুন পদ্ধতি বুঝে ফেলেন তারা।

পুরান ঢাকার আরেকজন তালার কারিগর আব্দুল লতিফ। তিনি চল্লিশ বছর ধরে তালা-চাবি সারাই ও বানানোর পেশায় আছেন। ঝড়, জল, বৃষ্টি, রোদ—সব গায়ে মেখে লতিফ বানিয়ে চলেছেন চাবি। তখনও লতিফ একখানা চাবির নকল বানাচ্ছিলেন। খুটখাট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দু-চারটে কথা ভেসে আসছিল এই কারিগরের মুখ থেকে।
টাঙ্গাইল জেলায় বাড়ি লতিফের। পরিবারের কেউ এই পেশায় ছিলেন না, কিন্তু তালা-চাবির প্রতি তীব্র আকর্ষণ কাজ করত তার মধ্যে। সাইকেলের তালা মেরামত, পাড়া-প্রতিবেশীIর তালা-চাবির টুকটাক সমস্যায় নিজে থেকেই এগিয়ে যেতেন। পরে ঢাকায় এসে এক ওস্তাদের কাছে তিন বছর ধরে কাজ শিখে এই পেশায় স্থায়ী হন। তালা-চাবির কাজকে আর ছাড়তে পারেননি—এই পেশাকে ভালোবেসে ফেলেছেন।
মাঝেমধ্যে গান জুড়ে দেন, আর গানের সঙ্গে চাবির নকল তৈরি করেন তিন মিনিটে। অবশ্য প্যাচের তালার চাবি কিছুটা সময়সাপেক্ষ—তা তিনি স্বীকার করলেন। দিনে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করেন লতিফ, তবে কোনো কোনো দিন এর থেকে কম হয়। কারো বাসায় ডাক পড়লে অবশ্য বেশি টাকা পান। চাবি হাতের নাগালে নেই অথচ দরজায় তালা পড়ে গেছে—এমন অবস্থায় বেশি ডাক পান।
গোলাকার লক সিস্টেম হলে দরজা থেকে গোল লক খুলে এনে চাবি বানাতে হয়, নতুবা ভেঙে ফেলতে হয় তালা। তবে লতিফের ছেলের আয় তার চেয়ে কিছুটা বেশি—সে ফেরি করে নানা জায়গায় চাবি সারাইয়ের কাজ করে।
এখন চাবি বানানোর কাজে একটি বিশেষ মেশিনের ব্যবহার শুরু হয়েছে, যাতে চাবির খাঁজগুলো দ্রুত কেটে নেওয়া যায়। তবে এই মেশিন সবার নেই। ১৪ বছর আগে ২৬ হাজার টাকা দিয়ে মেশিনটি কিনেছিলেন লতিফ। এখন এর দাম ৮০-৯০ হাজার টাকার কাছাকাছি—তাই সবাই কিনতে পারেন না।
মেশিন কেনার পর লোন শোধ করা পর্যন্ত কিছুটা সমস্যায় ছিলেন তিনি। তবে ঋণ শোধ হয়ে গেলে আর পেছনে তাকাতে হয়নি—বরং আয় বেড়ে গেছে। কেননা মেশিনের কারণে যে সময়ে একটি চাবি বানানো হতো, সেই সময়ে এখন দুই-তিনটি চাবি বানানো সম্ভব হয়।
"মাঝেমধ্যে চোর-ডাকাতরাও আমাদের কাছে আসে। সাবানের ওপর চাবির ছাপ দেখলেই বুঝতে পারি এ আসল মালিক নয়। আবার কেউ কেউ চাবি এঁকে আনে। এখন আবার চাবির ছবি তুলে আনার পদ্ধতিও ব্যবহার করে চোরেরা। কিন্তু তালা চাইলে তখন আর দিতে পারে না। সরাসরি চাবি এনে না দিলে আমি চাবির নকল করি না। অনেকক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্যে আসা এই লোকজন ৩০ টাকার চাবির নকল ৩০০ টাকায় করাতে চায়। কিন্তু যাতে মানুষের ক্ষতি হয়, সেই কাজ আমি করি না। কোনো কোনো কারিগর অবশ্য বানিয়ে দেন," জানাচ্ছিলেন আব্দুল লতিফ।
আব্দুল লতিফের কাছে চাবি তৈরি করতে এসেছিলেন সানজিদা শিমু। তিনি জানান, সুদূর রোকেয়া হল থেকে এখানে এসেছেন চাবি বানাতে। পাশে নিউমার্কেট থাকা সত্ত্বেও এতদূর কেন এলেন—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "এখানে আমি তিন বছর ধরে চাবির যেকোনো সমস্যায় আসি। নিউমার্কেটের কারিগররা দাম বেশি নেয়, আবার অনেক সময় নিখুঁত চাবি তৈরি করতে পারে না। বারবার রুম চেঞ্জ করার জন্য আমাকে অনেকগুলো চাবি বানাতে হয়েছে, সেসব কাজের জন্য একমাত্র ভরসার জায়গা লতিফ চাচা।"

ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় চাঁদনীচকের একটুখানি আগে ওভারব্রিজের নিচে দেখা গেল চাবির কারিগরদের বসতে। এদেরই একজন জানালেন, প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করেন তারা। নিউমার্কেট এলাকার আশপাশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় তাদের মূল খরিদ্দার হোস্টেল বা মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা।
একেকটি চাবির জন্য তারা ৫০ টাকা নেন। একসঙ্গে দুই-তিনটি বানালে কিছুটা ছাড় দেন। তবে এই এলাকার কারিগরদের মধ্যে আধুনিক মেশিনের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। প্রায় সবাই সনাতনী পদ্ধতিতে চাবি বানান ও তালা সারাই করেন। নতুন মেশিনের ব্যবহার যেহেতু এখানে কম, তাই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ও তুলনামূলক কম।
এই এলাকার কারিগরদের মতে, পুরোনো পদ্ধতিতে তারা যত দ্রুততার সঙ্গে চাবি বানাতে পারেন, নতুন পদ্ধতি আয়ত্তে আনতে তার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে।
ঢাকা শহরের গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার থেকে শুরু করে নানা এলাকায় তালা-চাবির কারিগরদের পাওয়া যায়। এলাকাভেদে তাদের খরিদ্দার ভিন্ন, এমনকি চাবিপ্রতি মজুরিও আলাদা।
তবে ইদানিং তারা তালা-চাবির পাশাপাশি অন্য ধরণের কাজও করছেন, যাতে আয়টা একটু বাড়ে। তেমনই একজন কুড়াতলি উচ্চ বিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশে বসা নুরুল ইসলাম। তিনি তালা-চাবির পাশাপাশি গ্যাসের চুলার বিভিন্ন সমস্যাও ঠিক করেন।
১৮ বছর ধরে নুরুল এই পেশায় নিয়োজিত। প্রাথমিক পর্যায়ে দুইখানা চাবি তৈরির মেশিন কিনে একাই কাজ শেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর করতে করতে শিখে নিয়েছেন পুরো কাজ।
কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—এআইইউবি, আইইউবি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়—থাকায় তার খরিদ্দারের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী দরদামে খুব একটা পারদর্শী নয় বলে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। পাশাপাশি কাছেপিঠে চাবি নকলের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই।
সে কারণে নুরুল চাবিপ্রতি সর্বনিম্ন ১০০ টাকা রাখেন। পাঁচ সদস্যের পরিবার নুরুলের আয়ে বেশ ভালোই চলে। তবে নুরুল চান না, তার সন্তান এই পেশায় আসুক। কারণ, একদিন যদি চার হাজার টাকা আয় হয়, অন্যদিন হয়তো ৫০০ টাকাও আয় নাও হতে পারে। এই অনিশ্চিত পেশার দিকে তিনি সন্তানকে ঠেলে দিতে চান না।
তবে ঢাকা শহরে তালা-চাবির কারিগরদের আয় যতটা, মফস্বলে ঠিক ততটা নয়। ঢাকায় ছোটাছুটির ভয়ে সময় বাঁচাতে মানুষ নিকটস্থ কারিগরের কাছেই চাবি বানিয়ে নেন। কিন্তু মফস্বলে অনেক সময় তালা ফেলে দিয়ে নতুন তালা কেনার মানসিকতাও দেখা যায় মানুষের মধ্যে।
সাতক্ষীরা সদরের বড় বাজারের রাস্তার মুখে, অত্যন্ত ভাঙাচোরা এক চিলতে ছোট্ট দোকানে তালা-চাবির কাজ করেন ইসমাইল মিয়া। ছোটবেলায় ক্লাস টুতে পড়ার সময় স্কুল পালিয়ে তালা-চাবির দোকানে এসে বসে থাকতেন। নাড়াচাড়া করতে করতেই টুকিটাকি কাজ শেখা। এরপর নিজেই তালা-চাবির দোকান খুলে বসেন।
তখন দোকান মানে পাকা মেঝে বা মাথার ওপর ছাদ নয়—একটা টুল, ধানের বস্তার ছালা, টুকটাক কলকব্জা। বৃষ্টির দিনে মাথায় একখানা ছাতা জুড়ে নিতেন, ব্যস। ৬২ বছর ধরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় তালা-চাবির দোকান দিয়ে কাজ করেছেন ইসমাইল, চালিয়েছেন সংসার।
তিনি বলেন, "মফস্বলে চাবি নকল করে কতই বা আয় হয়? তারপর পরিচিত লোক হলে মজুরি দিতে চায় না। অনেক সময় টাকা বাকি রেখে চলে যায়। তবু বুড়ো বয়সে এসে অন্য কী কাজই বা করব? যা পারি তাই দিয়ে দুটো ডাল-ভাত জোটে।"
চাবি বানানোর মেশিনের কথা শুনে চোখ চকচক করে ওঠে তার, দেখা যায় আধভাঙা দাঁতের হাসি। কিন্তু মেশিন কেনার সামর্থ্য কোথায়?
ছবি: তীর্থ বন্দ্যোপাধ্যায়