সন্তুরের শেষ কারিগর: বিলুপ্তপ্রায় কাশ্মিরী সুরশিল্প একা হাতে বাঁচিয়ে রেখেছেন যিনি
ভারতশাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের নির্জন, সরু গলির এক কোণে আলো-আঁধারিতে ঢাকা একটি ছোট ও পুরোনো কারখানা এখনো টিকে আছে।
এই দোকানের ভেতর বসে আছেন গুলাম মোহাম্মদ জাজ। কাশ্মীর অঞ্চলে তিনি হাতে তৈরি 'সন্তুর' বাদ্যযন্ত্র নির্মাতাদের শেষ জীবিত কারিগর হিসেবে পরিচিত। প্রতিবেদন বিবিসির।
সন্তুর হলো ট্রাপিজিয়াম আকৃতির এক ধরনের তারের বাদ্যযন্ত্র, যেটি কাঠের ছোট মুগুর দিয়ে বাজানো হয়। এটির তার স্বচ্ছ, ঘণ্টাধ্বনির মতো ধ্বণির জন্য পরিচিত এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কাশ্মীরি সঙ্গীতের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
গুলাম মোহাম্মদ এমন এক বংশের সদস্য, যারা সাত প্রজন্ম ধরে কাশ্মীরে তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে আসছেন। 'জাজ' পরিবার নামটি দীর্ঘদিন ধরে সন্তুর, রাবাব, সারেঙ্গী এবং সেতারের কারিগর হিসেবে স্বীকৃত।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতে তৈরি বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। তার জায়গা দখল করেছে মেশিনে তৈরি সস্তা আর দ্রুত উৎপাদনযোগ্য সংস্করণ। পাশাপাশি সঙ্গীতের রুচির পরিবর্তনও ঘটেছে।
"হিপ-হপ, র্যাপ আর ইলেকট্রনিক মিউজিক এখন কাশ্মীরের সংগীত দুনিয়া দখল করে নিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম আর ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের গভীরতা কিংবা শৃঙ্খলার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে না," বলছেন সঙ্গীত শিক্ষক শাবির আহমদ মির। এর ফলে সন্তুরের প্রতি আগ্রহ একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে, আর আগ্রহী নতুন কারিগর কিংবা স্থায়ী বাজার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

শতবর্ষ পুরোনো দোকানের এক কোণে কাঠের খোদাই করা একটি ফাঁপা ব্লক আর কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত লোহার সরঞ্জামের পাশে বসে কথা বলেন কারিগর গুলাম মোহাম্মদ।
"আর কেউ নেই এই কাজ শেখার কিংবা চালিয়ে নেওয়ার জন্য," তিনি বলেন, "আমি-ই শেষ।"
তবে সবসময় এমনটা ছিল না।
বছরের পর বছর ধরে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান সুফি ও লোকসঙ্গীতশিল্পীরা গুলাম মোহাম্মদের হাতে তৈরি সন্তুর বাজিয়ে এসেছেন।
সন্তুরের সুরে সাত প্রজন্মের গল্প
দোকানের এক কোণে ঝুলছে একটি পুরোনো ছবি যেখানে সন্তুর হাতে সুর তোলায় ব্যস্ত কিংবদন্তি পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা ও ভজন সোপোরি। দুজনেই গুলাম মোহাম্মদ জাজের হাতে তৈরি সন্তুর বাজিয়ে দেশ-বিদেশ মাতিয়েছেন।
ধারণা করা হয়, সন্তুরের উৎপত্তি পারস্যে। ১৩শ বা ১৪শ শতকে এটি মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে পৌঁছায় ভারতে। কাশ্মীরে এসে এটি পায় এক স্বতন্ত্র পরিচয়, সুফি কবিতা ও লোকসংগীতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এই বাদ্যযন্ত্রটি।
"প্রথমদিকে সন্তুর ছিল সুফিয়ানা সঙ্গীতের অংশ, যার ধ্বনি ছিল কোমল ও লোকজ ," বলেন সঙ্গীত শিক্ষক শাবির আহমদ মির।
পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা পরবর্তীকালে সন্তুরকে ভারতীয় ধ্রুপদি সঙ্গীতের উপযোগী করে তোলেন। এজন্য তিনি তার সংখ্যা বাড়ান, ব্রিজগুলো পুনর্গঠন করে্ন আর নতুন যন্ত্রকৌশল যোগ করেন এতে।
কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত ভজন সোপোরি সন্তুরে আনেন সুফি প্রাণ, "উনি এই বাদ্যযন্ত্রটির সুরব্যাঞ্জনা গভীর করেন, আর তখন সুফি সংগীতের জন্য এটি আরও শুতিমধুর হয়ে ওঠে" , আরও বলেন মির।

আরেক ছবিতে দেখা যায়, ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার নিচ্ছেন গুলাম মোহাম্মদ। তার অসামান্য কারুশিল্পের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পান তিনি।
গুলাম মোহাম্মদের জন্ম ১৯৪০-এর দশকে কাশ্মীরের ঐতিহাসিক এলাকা জৈনা কাদালে। জৈনা কাদাল নামটি এসেছে একটি বিখ্যাত সেতুর নামে, যা একসময় কাশ্মীরের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির প্রাণ ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার চারপাশ ছিল বাদ্যযন্ত্র তৈরির শব্দ আর সরঞ্জামে পূর্ণ।
স্বাস্থ্যগত কারণে স্কুল ছেড়ে দেন অল্প বয়সেই। তখনই বাবার ও দাদার হাত ধরে শেখা শুরু হয় সন্তুর বানানোর শিল্প। তারা দুজনেই ছিলেন দক্ষ বাদ্যযন্ত্রকার।
"তারা শুধু যন্ত্র বানানো শেখাননি, শেখান কানে শোনা, কাঠের শব্দ, বাতাসের চলন আর যে হাত এটা বাজাবে তার অনুভব," বলেন গুলাম মোহাম্মদ, "আমার পূর্বপুরুষদের রাজদরবারে ডাকা হতো। তাদের বলা হতো এমন যন্ত্র বানাতে, যার সুরে মন শান্ত হয়।"
দোকানে কাঠের একটা বেঞ্চে ছড়িয়ে আছে কাঠ আর তার। পাশে পড়ে আছে অসম্পূর্ণ সন্তুরের কাঠামো। বাতাসে পুরোনো আখরোট কাঠের মৃদু ঘ্রাণ, তবে কোথাও কোন মেশিন নেই।
গুলাম মোহাম্মদের বিশ্বাস, হাতে তৈরি যন্ত্রে যে উষ্ণতা আর গভীরতা থাকে, মেশিন-নির্মিত যন্ত্র তা দিতে পারে না। শব্দমানের দিক থেকেও দুয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক।
সন্তুর বানানো এক গভীর মনোযোগ ও ধৈর্যের কাজ। শুরু হয় কাঠ বাছাই দিয়ে, যা কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে শুকানো আর পরিপক্ব হওয়া প্রয়োজন। এরপর কাঠ কেটে ফাঁপা করা হয় সঠিক অনুরণনের জন্য। সন্তুরের ২৫টি ব্রিজ একে একে খোদাই করে বসানো হয় নির্ভুলভাবে।
এরপর ১০০-র বেশি তার লাগানো হয়। এরপর শুরু হয় সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ পর্ব, সুর মেলানো। এই কাজ চলে সপ্তাহজুড়ে, কখনো কখনো মাস ধরে।
'এটা শুধু কাঠের কাজ নয়, এটা কবিতা'
"এটা ধৈর্য আর নিষ্ঠার কাজ," বলেন গুলাম মোহাম্মদ জাজ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা এসেছেন তার দোকানে, ভিডিও বানিয়েছেন, অনলাইনে ছড়িয়েছেন সন্তুরের গল্প। এ নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই। বরং এমন আগ্রহের প্রশংসা করেন তিনি। তবে আক্ষেপও আছে, "এই ভালো মানুষগুলো আসে, কিন্তু আমার পর এই জায়গাটার কী হবে?"
তিন মেয়ের কেউই পারিবারিক এই পেশায় আসেননি। প্রত্যেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন ক্যারিয়ার। তাই গুলাম মোহাম্মদের ভাষায়, "পরের কেউ নেই।"
বছরজুড়ে নানা প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি, সরকারি অনুদান, শিষ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, এমনকি রাজ্যের হস্তশিল্প দপ্তরের পক্ষ থেকেও কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে।
তবু গুলাম মোহাম্মদের মন ভরেনি।

"আমি খ্যাতি চাই না, করুণাও চাই না," বলেন তিনি, "আমি চাই কেউ এই শিল্পকে ভালোবেসে এগিয়ে নিয়ে যাক।"
৮০ পেরোনো এই কারিগর এখন অনেক সময় কাটান একটি অসমাপ্ত সন্তুরের পাশে বসে, শুনতে চেষ্টা করেন সেই নিঃশব্দতা, যা এখনও সুর হয়ে ওঠেনি।
"এটা শুধু কাঠের কাজ নয়," বলেন তিনি, "এটা কবিতা। একটা ভাষা। আমি যন্ত্রকে কণ্ঠ দিই, যাতে সে কথা বলতে পারে।"
"সন্তুর বাজানোর আগে আমি তার সুর শুনতে পাই," নরম কণ্ঠে বলেন তিনি , "এইটাই রহস্য। এইটাই উত্তরাধিকার।"
তিনি আরও বলেন, "কাঠ আর সংগীত, দুটোই মরে যায়, যদি তুমি তাদের সময় না দাও।"
"আমি চাই কেউ এই শিল্পটাকে ভালোবেসে গ্রহণ করুক। টাকার জন্য নয়, ক্যামেরার জন্য নয়, শুধু সুরের জন্য," সবশেষে বলেন গুলাম মোহাম্মদ।
বাইরের পৃথিবী যখন আধুনিকতার পেছনে দৌড়াচ্ছে, তখন তার ছোট দোকানটি যেন সময়ের বাইরে, খুব ধীরে, নিঃশব্দে, আখরোট কাঠের গন্ধে পূর্ণ হয়ে রয়েছে ঠিক যেন একটি আলাদাই জগত।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা