বাদ্যযন্ত্র, হিজড়া ও হকার নিষিদ্ধ করে ঝিনাইদহের গ্রামে নোটিশ

বাদ্যযন্ত্র বাজানো, হকার প্রবেশ ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রবেশ নিষেধ করেছে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার একটি গ্রাম। এসব নিয়ম ভঙ্গ করলেই গুনতে হবে জরিমানা, নেয়া হবে মা-বাবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা। গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি নোটিশ গ্রামের বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো হয়েছে।
শড়াতলা গ্রামের সমাজপতিরা দাবি করেছেন, গ্রামে সহিংসতা প্রতিরোধ, তরুণদের পড়াশোনায় মনোযোগী করা এবং তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের 'অসদাচরণ' রোধ করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় শড়াতলা মসজিদ কমিটির সভাপতি এনামুল হকের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ নিয়ম চালুর সিদ্ধান্ত হয়।
এ সংক্রান্ত একটি নোটিশ একশ' টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে এর ফটোকপি গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো হয়। স্টাম্পে স্বাক্ষরিত ১৮ জনের রয়েছে রাজনৈতিক ও শিক্ষকতার বিভিন্ন পরিচয়। স্বাক্ষরের জায়গায় হরিণাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সরকারি নম্বরও আছে।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে শড়াতলা গ্রামের পশ্চিম-পাড়া মসজিদের সভাপতি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, স্থানীয় দোকানদার, মসজিদের ইমাম, বিএনপির স্থানীয় কমিটির সভাপতি, ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক, স্থানীয় প্রশাসনের মেম্বার, ব্যবসায়ী এবং দলিল লেখক রয়েছেন।
স্ট্যাম্পে লেখা নোটিশে উল্লেখ করা হয়, সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো। কেউ নিয়ম লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
এছাড়াও, নোটিশে উল্লেখ করা হয় যে, কেউ এ নিয়ম ভঙ্গ করলে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই নয়, তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রামের সকল প্রকার হকার নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রবেশও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
নোটিশে আরও বলা হয়, যেহেতু গ্রামের ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত ও ২০ জনের মত সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছে। তাই নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শড়াতলা গ্রামের বাসিন্দা কোরবান আলী বলেন, রাতে গানবাজনা বাজালে ছেলেরা লেখাপড়া করবে কীভাবে? এতে অসুস্থ মানুষদেরও সমস্যা হয়। হিজড়ারা গানবাজনা বাজিয়ে জোর করে গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে টাকা নেয়। আবার হকাররাও উচ্চ শব্দে হর্ণ বাজায়। এসব কারণেই গ্রামের মানুষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনও অবশ্য বিষয়টি আমলে নিয়েছে। এনিয়ে হরিণাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম তারিক-উজ-জামান বলেন, কী উদ্দেশ্য কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারাই ভালো জানে। সমাজটা সবার। নিজেরা আইন করে নিজেদের ইচ্ছামতো কার্যক্রম চালাবে সেটা হতে পারে না। কেউ যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবার স্বাধীনতা রয়েছে।
অভিযুক্ত মসজিদ কমিটির সভাপতি এনামুল হক বলেন, আমরা অনেকেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। হিজড়ারা গ্রামের মানুষদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে, আর উঠতি বয়সী যুবকরা উচ্চ শব্দে গানবাজনা বাজায়। এসব কারণে গ্রামের মানুষের সমস্যার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে এটা করা আমাদের ভুল হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত শড়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাশিউর রহমান বলেন, বৈঠকে আমিও ছিলাম। প্রথমে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু বিষয়টি এতদূর গড়াবে বুঝতে পারিনি। বিধিবহির্ভূত কাজের সঙ্গে জড়িত থাকা উচিত হয়নি।
ঝিনাইদহ হরিণাকুন্ডু থানার ওসি আব্দুর রউফ জানান, বিষয়টি জানার পর আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কেউ নিজে থেকে আইন তৈরি করলে মেনে নেওয়া হবে না। নিয়ম মেনে সকল কর্মকাণ্ড চলবে।
এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরাও। ঝিনাইদহের সাংস্কৃতিক কর্মী নাজিম উদ্দিন জুলিয়াস বলেন, যারা এ নিয়ম জারি করেছে তারা সমাজবিরোধী। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। নয়তো এ ধরনের ঘটনা তারা নিয়মিত ঘটাবে। সমাজের মানুষদের সব কিছু মানিয়ে নিতে হবে।
ঝিনাহদহের এ গ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে ভোটার রয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৫০০।