পরিচালক হওয়ার পর দেখলাম, আমি যেন ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার: ঢাবির বোস সেন্টার নিয়ে অধ্যাপক মামুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬টি রিসার্চ সেন্টার নিয়ে একটি ফিচার আর্টিকেল ছাপিয়েছে দৈনিক The Business Standard (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড) পত্রিকায়। তারা শিরোনাম করেছে "ছাপ্পান্নটি গবেষণা কেন্দ্র! নিজের 'কীর্তি' নিয়ে দিশেহারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!" এই আর্টিকেলটি লেখার আগে তারা আমার কাছেও এসেছিল। বর্তমান ভিসি নিয়োগ পাওয়ার একদম প্রথম দিকেই আমাকে বোস সেন্টারের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিল। ভেবেছিলাম এই প্রশাসন হয়তো বোস সেন্টারকে উন্নত করতে আন্তরিক হবে। তাছাড়া সেই সময় আমি বোস-আইনস্টাইন তথা কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের তত্ত্বের জন্ম শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে একটি কনফারেন্সের আয়োজন করছিলাম। ভাবলাম বোস সেন্টারের পরিচালক হলে কনফারেন্স আয়োজনও সহজ হবে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল আর আমিও এই নিয়োগ গ্রহণ করি।
আরও পড়ুন: ছাপ্পান্নটি গবেষণা কেন্দ্র! নিজের 'কীর্তি' নিয়ে দিশেহারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচালক হওয়ার পর দেখলাম, আমি যেন ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। এখানে পদের কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। বোস সেন্টারের বয়স এখন একান্ন বছর। আমি যখন দায়িত্ব নেই তখন এর বয়স ছিল ৫০! এর আউটপুট কী? তার আগে বলে নেই ৫০ বছর পুরোনো একটি সেন্টারের কি আছে! বিজ্ঞান কারখানায় এক রুমের একটি অফিস, আর সেখানে আছে দুজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এবং একজন পরিচালক। কিছু ছাত্রকে ফেলোশিপ দিয়ে মাসে মাসে তাদের টাকার চেক দেওয়া আর প্রতিদিন একগাদা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়াই যেন পরিচালকের কাজ। এখানে না আছে ইন-হাউজ পোস্ট-ডক ফেলো, না আছে নিজস্ব পিএইচডি ফেলো, না আছে নিজস্ব গবেষক। যাদের ফেলোশিপ দেওয়া হয়, তারা নিজ নিজ বিভাগে থেকেই গবেষণা করে। টাকা দেওয়া ছাড়া বোস সেন্টারের কোনোই কাজ নেই। অথচ এই কাজ তো রেজিস্ট্রার ভবনের কর্মকর্তারাই করতে পারতো। এর জন্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে একটি সেন্টার (বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল সায়েন্সেস) করার কোনো মানে আছে?
আমি দায়িত্ব নিতে বেশ উৎসাহ বোধ করেছিলাম। মৃতপ্রায় গবেষণাকেন্দ্রটিকে সক্রিয় করে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ১৯২৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক সত্যেন বসু কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্স তত্ত্ব আবিষ্কার করে চমকে দিয়েছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইনকে। পরবর্তীকালে বোস-আইনস্টাইন থিওরি সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা তৃতীয় বা চতুর্থ বছরে এটি না পড়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করতে পারে না। এইরকম একটি তত্ত্বের জন্মস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। ভাবতে পারছেন এর গুরুত্ব? আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলে এই প্রশাসনেরই সুনাম বাড়তো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তো।
তাই গবেষণা কেন্দ্রটির পুনরুজ্জীবন জরুরি মনে করেছিলাম। নইলে যে সত্যেন বসুকে অসম্মান করা হয়। ৫০ বছর যার বয়স সেটি একটি রুম ও দুইজন কর্মচারী থেকে বড় হতে পারলো না কি দুঃখজনক না? ইন ফ্যাক্ট, এই রুমটিও ছিল না। অধ্যাপক শামীমা করিম যখন এর পরিচালক হন তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি রুম হয়। আমরা যে গুণীদের সম্মান দিতে জানি না এটি তার অন্যতম প্রমাণ। গত বছরই আমি কলকাতার এসএন বোস সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্স সেন্টারে গিয়েছিলাম। সেখানে কর্মচাঞ্চল্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি একই সাথে আমাদের সাথে তুলনা করে লজ্জিত হয়েছি। সেখানে সল্ট লেকে বিশাল জায়গা জুড়ে এই সেন্টার। বিশাল অবকাঠামো। আছে এডমিনিস্ট্রেটিভ ভবন, গেস্ট হাউস, ৩০-৫০ জন পোস্ট ডক, অনেক পিএইচডি ছাত্র এবং প্রায় ৫০ জনের মত ইন-হাউজ ফ্যাকাল্টি। আছে বিশাল মনোরম গেস্ট হাউস যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নিয়মিত অতিথিরা এসে কোলাবোরেশন গবেষণা করছে। তাই আমি বোস সেন্টারের জন্য এক মোটামুটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করি। আমি চেয়েছিলাম এটিকে উন্নীত করে একটি অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টার করা হোক যেখানে বিশ্বমানের পোস্ট-ডক ও পিএইচডি শিক্ষার্থী থাকবে, মাস্টার্স এর শিক্ষার্থী থাকবে এবং উচ্চতর কোর্স অফার করা হবে। কর্তৃপক্ষ তার কিছুটা বুঝেছে, অনেকটাই বোঝেনি অথবা সবটাই উপেক্ষা করেছে। কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন ভোট অথবা দলবাজি, যার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন থাকা যায়, সেখানে বোস সেন্টারের উন্নতি-অবনতি খুবই গৌণ বিষয়। একটি জরাজীর্ণ কক্ষে বোস সেন্টার, অথচ এর থেকে ভালো ফল পেতে চাইলে কার্জন হলের পুরো একটি ভবন প্রয়োজন। তাই সিদ্ধান্ত নেই পরিচালক আর থাকব না এবং পদত্যাগ করলাম।
আসলে আমি অনেকদিন ধরে বলে আসছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬টি রিসার্চ সেন্টারের প্রয়োজন নেই। প্রতি অনুষদে ২টি বা ৩টি রিসার্চ সেন্টার করলেই হয়। সংখ্যা ম্যাটার করে না। গুরুত্ব দিতে হবে মানে। মান পেতে হলে গবেষণার ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। ভেবেছিলাম গণ অভ্যুত্থানের পর এইসব সংস্কার হবে। ভেবেছিলাম গণ অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয় দলান্ধ ছাত্র শিক্ষক রাজনীতির পরিবর্তে শিক্ষা ও গবেষণামুখী হবে। দেখলাম কিচ্ছু হলো না। সমাজ এবং সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝেও এই আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু সব ছিনতাই হয়ে গেল। আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান বদলালো না।
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বোস সেন্টার ফর এ্যাডভান্সড স্টাডি এন্ড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল সায়েন্স-এর সাবেক পরিচালক। লেখাটি তার ফেসবুক থেকে নেওয়া।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।