জিআই স্বীকৃতি পাওয়া সিরাজদিখানের পাতক্ষীর: না মিষ্টি না টক, তবু স্বাদে অদ্ভুত

ভোর হতে তখনো দুই ঘণ্টা। ফিকে হয়ে আসার আগে অন্ধকার থাকে থোকা থোকা। তবে পথ চিনে নিতে নন্দ ঘোষের কষ্ট হয় না। প্রায় দিন এমন সময়েই তিনি বাড়ি থেকে বের হন, স্ত্রী পাড়ার বটগাছটি পর্যন্ত এগিয়ে দেন। নন্দ ঘোষ পথে নামেন ডান কাঁধে একটি বাঁক নিয়ে, যেটার দুই ধারে পাঁচটি করে মাটির হাঁড়ি থাকে। হাঁড়িগুলোয় থাকে কলাপাতায় মোড়ানো পাতক্ষীর।
নন্দ ঘোষের গন্তব্য তালতলা লঞ্চঘাট। এটা এমন এক সময়ের কথা যখন ধলেশ্বরী শুকিয়ে আধমরা হয়ে যায়নি, বুড়িগঙ্গার পানিতে তখনো ডলফিনেরা খেলা করত। ধলেশ্বরীর পারের এক জমজমাট গঞ্জ তালতলা। সেকালের জীবন নদী ছাড়া চলত না। কেনা-বেঁচা, ওঠা-বসা সবই হতো নদীকে ঘিরে। তালতলাও ব্যতিক্রম ছিল না। মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানা সদরের ভূমি অফিসের উলটো দিকে সন্তোষপাড়া। সেখানে নন্দসহ শত ঘর ঘোষের বসবাস। সম্প্রতি জিআই পণ্যের তালিকায় নাম লিখিয়েছে সন্তোষপাড়ার পাতক্ষীর।
ওপরের ভাড়া দেড়গুণ
সন্তোষপাড়া থেকে হেঁটে লঞ্চঘাট পৌঁছাতে নন্দ ঘোষের আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। সকাল ৭টার লঞ্চ ধরতে পারলে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছানো যায় সকাল ১০টায়। একটি লঞ্চ মিস করলে পরেরটির জন্য ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়।
এমভি দারাশিকো, এমভি মধ্যপাড়া ইত্যাদি নাম লঞ্চগুলোর। এগুলো দোতলা, কাঠবডির লঞ্চ। ওপরে কেবিনের ভাড়া দেড়গুণ। মানে নিচের ভাড়া ৩০ টাকা হলে ওপরে ৪৫ টাকা।
টিকিট মাস্টারের সঙ্গে ভালোই জানাশোনা নন্দ ঘোষের, প্রতিদিনের যাতায়াত, সেই সূত্রে একরকম বন্ধুই বলা যায়। মাস্টারের কাঁধে একটি চামড়ার ব্যাগ ঝোলানো থাকে। টাকা আর পয়সা রাখার দুটি আলাদা পকেট। বাম হাতে রাখেন টিকিট আর ডান হাতে কলম। কখনো কখনো কলমটিকে কানে গুঁজে রাখতেও দেখা যায়। কে কোন ঘাটে নামবে, তা জেনে পেঁচিয়ে ভাড়ার অংক লিখে কলমটিকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেন।
সকালের লঞ্চেই ভিড় বেশি হয়। তবে তার মধ্যেও মাস্টার ঘুরতে ঘুরতে নন্দ ঘোষের পাশ কেটে যান আর জানা প্রশ্নই আবার শুধান, 'আজ কয় হাঁড়ি আনছো ঘোষের পো? দিনকাল চলছে কেমন?'
গাঢ় দুধে ক্ষীর ভালো
নন্দ ঘোষ অনেকদিন ধরেই ভাবছেন মাস্টারকে একবার এক পাতা ক্ষীর দেবেন। কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারেন না। এক পাতা ক্ষীর তার সারাদিনের রোজগার। সওয়ারিঘাট, ফরাশগঞ্জ, রায়সাহেব বাজার ঘুরে ঘুরে ক্ষীরগুলো তিনি বিক্রি করেন। হাঁড়িপ্রতি ৮-১০ টাকা তার লাভ থাকে। বিক্রি করতে কোনোদিন দেরি হয়ে গেলে ঘাটে পৌঁছে দেখেন শেষ লঞ্চটি ছেড়ে গেছে। বাড়ির লোকে চিন্তা করে, তার চেয়েও বড় কথা ঘুমাতে হয় ঘাটে। পরের দিন প্রথম লঞ্চ ধরে বাড়ি যান। গিয়ে স্নান সারেন, ভাত খান, আগের দিনের ক্ষীর যাচাই করে দেখেন। এমনিতে ক্ষীর দুই-তিন দিন তাজা থাকে। তবু রুটিন চেক আরকি! সেদিন আর নতুন করে ক্ষীর পাতেন না, টুকটাক বাজার করেন, দুধের বাজার ভালো করে খেয়াল করেন।
দুধওয়ালারা বসে রাস্তার দুই ধারে সারি বেঁধে। সব দুধ ক্ষীরের জন্য ভালো না, গাঢ় বা ভারী দুধে ক্ষীর ভালো হয়। এর জন্য প্রয়োজন সেই গরুর দুধ, যেটার বাছুরের বয়স ৮ থেকে ১০ মাস।
পরের দিন সব ক্ষীর বিক্রি করে ঘরে ফেরেন, শোল মাছের সালুন (তরকারি) দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমাতে যান। পরদিন বাজার ঘুরে ৩০ কেজি দুধ কেনেন। বাড়ির ছোট্ট উঠানে ততক্ষণে নন্দ ঘোষের স্ত্রী লাকড়ি (কাঠের জ্বালানি) জড়ো করেছেন, কড়াইগুলো ধুয়ে-মুছে সাফ করেছেন। সে আমলে ছোট ছোট কড়াই ছিল সম্বল। একটি কড়াইয়ে তিন কেজির বেশি দুধ ঢালা সম্ভব ছিল না।
নন্দ ঘোষ দুধ নিয়ে বাড়ি ফেরার পর ১০টি কড়াই আলাদা ১০টি চুলায় বসিয়ে আগুন জ্বেলে দেন। সে দুধ জ্বাল দিতে হয় তিন থেকে চার ঘণ্টা। নাড়তেও হয় সারাক্ষণ। যখন দুধ থেকে সবটা পানি উড়ে যায়, তখন ঘন রোয়া ওঠা ক্ষীর কড়াইয়ে ফুটে ওঠে। নতুন ধানের শিশির ভেজা শীষ দেখে যেমন কৃষকের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে, নন্দ আর তার স্ত্রীর মুখেও তেমন আনন্দের হাসি দেখা যায় তখন।
কলাপাতায় বলে পাতা ক্ষীর
কড়াই থেকে ক্ষীর ঢালা হয় প্রথমে মাটির হাঁড়িতে। তারপর কিছুটা ঠান্ডা হয়ে এলে কলাপাতায় ঢালা হয়। গরম ক্ষীর খেতে মন্দ নয়, তবে বেশি ভালো ঠান্ডা হওয়ার পর। ততক্ষণে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে থাকে। যতটা পারা যায় পরিপাটি হয়ে পাড়ার আখড়ায় যান যেখানে কীর্তন হয় প্রতি সন্ধ্যায়। রাত অল্প গভীর হলেই আসর ভাঙে। কারণ পরের দিনের লঞ্চ ধরতে হবে অনেককেই।

সন্তোষপাড়ার সব ঘরেই পাতক্ষীর তৈরি হয়। কলাপাতায় করে বিক্রি হয় বলে এর নাম পাতা ক্ষীর বা পাতক্ষীর। সারাদেশে কেবল এই একটি পাড়াতেই তৈরি হয় পাতক্ষীর। এর স্বাদ বলে বোঝানো মুশকিল। এটি না মিষ্টি না টক, না অন্য কিছু, কিন্তু স্বাদে অদ্ভুত ভালো।
বর্তমানের সিরাজদিখান বাজারে সন্তোষপাড়ার ঘোষেদের ১২-১৩টি মিষ্টির দোকান আছে। রসগোল্লা, রসমালাই, কালোজাম, রসমালাই, দই ইত্যাদি দোকানগুলোয় বিক্রি হয় বটে, তবে বিশেষ আকর্ষণ পাতক্ষীর।
ঢাকা, সিলেট, বরিশাল, ফরিদপুর থেকেও ক্রেতারা আসেন পাতক্ষীরের টানে। এখন আর আগের দিনের মতো ঢাকায় হেঁটে হেঁটে পাতক্ষীর বিক্রি করতে হয় না, ক্রেতারাই সিরাজদিখান চলে আসেন। একেকজন ৫ বা ১০ পাতা ক্ষীর কিনে নিয়ে যান।
সুনীল ঘোষের তাফাল
সিরাজদিখান বাজারের সবচেয়ে নামকরা ক্ষীরের দোকান সুনীল ঘোষের। সুনীল ঘোষ আর বেঁচে নেই। দোকান পরিচালনা করেন তার ভাই খোকন ঘোষ।
কেন সুনীল ঘোষের ক্ষীর ভালো? খোকন ঘোষ বললেন, 'আমরা কোনো প্যাজগী (ভেজাল অর্থে) করি না। আমাগ ক্ষীরে একাইজ (একশভাগ) দুধ থাকে। এক তোলা সমান চিনি মিশাই আর রং আনার জন্য এক চিমটি খাবার হলুদ। একটু খাইলেই বুঝবেন আমাগ ক্ষীর আলাদা কেন?'

খোকন ঘোষ জানালেন, তাদের এটি পাঁচ পুরুষের ব্যবসা। তবে নাম হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। ৫০-এর দশকের শেষভাগে যখন তিনি খুব ছোট তখন বিকেল বেলা দোকানে এসে বসে থাকতেন। সে আমলে ১২ আনা বা ১৪ আনায় এক কেজি ক্ষীর বিক্রি হতো। এক কেজি ক্ষীর তৈরিতে ৬ কেজি দুধ লাগে। এক পাতায় থাকে ৫০০ গ্রাম বা আধা কেজি ক্ষীর। গরমের দিনে ৭০ পাতা ক্ষীর তারা বিক্রি করেন, যখন সারা বাজারে বিক্রি হয় ১৫০ পাতা। আর শীতের দিনে দেড় ২০০ পাতা ক্ষীর বিক্রি করেন। তাদের কারখানা দোকানের সঙ্গেই। সেখানে বড় বড় তাফাল (টিনের তৈরি আয়তাকার পাত্র) আছে। এগুলো প্রয়োজনমতো বানিয়ে নেন।
ফি বছর নতুন নতুন তাফাল দরকার হয়। একেকটির দাম পড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। প্রতিটিতে ৫ মণ দুধ আঁটে। তবে ৩ মণের বেশি ঢালা হয় না। তাহলে নাড়াচাড়া কর যায় ইচ্ছেমতো। লাকড়ি দিয়েই দুধ জ্বাল দেওয়া হয়। কারণ, গ্যাসের আগুনে স্বাদ ভালো পাওয়া যায় না।
বড়দিনে ২০০ পাতা ক্ষীর
সুনীল ঘোষের নাম হয়েছে তোশিকি কাইফুর কল্যাণে। '৮৯ সালের আগস্ট থেকে '৯১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশ সফরের সময় তাকে সুনীলের পাতক্ষীরে তৈরি পাটিসাপটা পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। তিনি খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং প্রশংসা করেছিলেন। ফলে নাম আগে যা ছিল এবার তা শতগুণে বৃদ্ধি পেল।
এরপর থেকে প্রতি ২৫ ডিসেম্বর বড় দিনে সুনীল ঘোষের দোকান থেকে ২০০ পাতা ক্ষীর বঙ্গভবনে সরবরাহ করা হয়।
খোকন ঘোষ জানালেন, এ ক্ষীর নানাভাবে খাওয়া হয়। চলতি মৌসুমে ক্ষীরের সঙ্গে আম গুলে খাওয়ার চল আছে। শীতের সময় পাটিসাপটা পিঠার পুর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভাত বা মুড়ির সঙ্গে মেখেও এ ক্ষীর খাওয়া যায়। অনেকে আবার শুধু শুধু খেয়েও তৃপ্তি লাভ করেন। মোট কথা এটি খেতে বাহানা লাগে না।
এত দুধ কোথায় পান জানতে চাইলে খোকন ঘোষ বললেন, 'প্রতিদিন সিরাজদিখান বাজারে ২০০ কেজি দুধ ওঠে। মিষ্টির দোকানিরা ভাগাভাগি করে তা কিনে নেন। আমরা খবর রাখি, কোন গরুর বাচ্চার বয়স কত? তাহলে ক্ষীরের জন্য দুধ বাছাই করতে কষ্ট হয় না।'
সন্তোষপাড়ার পাতাক্ষীর সম্প্রতি জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্যের মর্যাদা পেয়েছে। এটা দিয়ে পণ্যের উৎপত্তিস্থল ও স্থানের বিশেষত্ব চিহ্নিত হয়। এতে পণ্যের পসার বৃদ্ধি পায়।
খোকন ঘোষের কাছে জানতে চাইলাম, কী কারণে কেবল সন্তোষপাড়াতেই পাতাক্ষীর উৎপন্ন হয়? তিনি জানালেন, অন্য ঘোষপাড়াতেও এটি তৈরি করা যেতে পারে। তবে সব জায়গার জল, ঘাস, হাওয়া একরকম নয়। তাছাড়া হাতযশ বলে একটা কথা আছে। এটি হঠাৎই তৈরি হয় না, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তৈরি হয়।

এ ক্ষীরের প্রসার ঘটাতে সন্তোষপাড়ার নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তারা অন্য আর দশটি কাজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের জন্য ক্ষীর তৈরি করতেন। পরবর্তীকালে এটাই ব্যবসায়িক রূপ লাভ করে।
খোকন ঘোষের ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই ডাক্তার। অন্য ভাইয়ের ছেলেরা ইউপি মেম্বার বা সরকারি চাকরি করে। বিদেশেও থাকে এক-দুজন। তাদের কারোরই ব্যবসায় মনোযোগ নেই।
খোকন ঘোষের তাই দুঃখ খুব, একদিন হয়তো তার পরিবারের এ হাতযশ হারিয়ে যাবে। স্মৃতি ধরে রয়ে যাবেন শুধু দু-চারজন।
ছবি: সালেহ শফিক