জলবায়ু অভিবাসী ও জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা
প্রতিদিন সকালে ঢাকার যানজটে ভরা রাস্তায় রিকশা নিয়ে বের হন ইউনুস মৃধা। কিন্তু এই যাত্রার পেছনে লুকানো থাকে তার জীবন সংগ্রাম। ৫০ বছর বয়সী এই মানুষটি কল্যাণপুরের নতুন বাজার বস্তিতে মাত্র ৩০০ বর্গফুটের এক ছোট ঘরে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে থাকেন।
তাদের গল্প শুরু রাজধানী থেকে অনেক দূরে, বরগুনায়। ঘূর্ণিঝড় সিডর তাদের ঘরবাড়ি ও সব সম্পদ কেড়ে নেয়। বাধ্য হয়ে তারা ঢাকা পাড়ি জমান। ইউনুস প্রথমে একাই এসেছিলেন, একার উপার্জনে কোনোভাবে টিকে ছিলেন। পরে কয়েক বছর পর পরিবারকে নিয়ে আসেন।
ইউনুস বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের পর আমরা সব হারাই। একার উপার্জনে বাঁচা খুব কষ্টের ছিল।' এখন তার স্ত্রী গৃহকর্মীর কাজ করেন, আর বড় ছেলে একটি গাড়ি মেরামতের গ্যারেজে কাজ করে। তাদের সম্মিলিত আয়েই কোনোভাবে চলে সংসার। ইউনুস বলেন, 'গ্রামে আর আমাদের ঘর নেই। এখানেও বস্তির ভাড়া বাসায় থাকা মানে প্রতিদিনই নতুন এক লড়াই।'
ইউনুস মৃধা একা নন। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক আবাসন নেই। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১ কোটিরও বেশি আবাসন ঘাটতি দেখা দেবে।
গতকাল (৫ অক্টোবর) বিশ্ব বসতি দিবস পালন করা হয়েছে এমন সময়ে, যখন বাংলাদেশের শহুরে আবাসন সংকটকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। জলবায়ুজনিত অভিবাসন, জনসংখ্যার চাপ ও পরিবেশের অবনতি মিলে এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
এ বছরের প্রতিপাদ্য 'আরবান ক্রাইসিস রেসপন্স' বা 'শহুরে সংকট মোকাবিলা'। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এই প্রতিপাদ্য যেন একেবারেই প্রাসঙ্গিক। জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ ও ভঙ্গুর অবকাঠামোর কারণে বহুদিন ধরেই রাজধানীকে 'আরবান আইসিইউ' বা 'শহুরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র' উপমা দেওয়া হয়।
একসময় বাগান ও লেকের শহর হিসেবে পরিচিত ঢাকা এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল। প্রতিদিনই গ্রাম থেকে শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবিকার সন্ধানে আসা মানুষের ঢল এই সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে।
চাপের মুখে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো
গ্রামে টিনশেড ও পাকা ঘরবাড়ি বাড়লেও শহরের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় করছে শুধু ভাড়ার পেছনে। আর নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো গাদাগাদি করে থাকছে অস্বাস্থ্যকর বস্তি ও ঘিঞ্জি এলাকায়, যেখানে পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা প্রায়ই অনির্ভরযোগ্য।
সরকারের শত শত একর জমি অব্যবহৃত পড়ে থাকলেও গত দুই দশকে শুরু হওয়া প্রায় ৫০টি আবাসন প্রকল্পের অল্প কয়েকটিই শেষ হয়েছে। জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বাকি প্রকল্পগুলো অগ্রসর হয়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, দেশের ৬০ লাখ আবাসন ঘাটতি সরাসরি প্রভাব ফেলছে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জীবনে— এদের বেশিরভাগই বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের পরিবার।
তার মতে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে সামাজিক আবাসন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার না দিলে এবং বেসরকারি প্রকল্পে সাশ্রয়ী ইউনিট বাধ্যতামূলক না করলে নীতিমালা ও বাস্তব চাহিদার মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়বে।
সরকারি প্রচেষ্টা এবং সীমাবদ্ধতা
সরকারও সংকট মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ 'আশ্রয়ণ প্রকল্প', যার মাধ্যমে ১৯৯৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজারেরও বেশি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসিত হয়েছে।
ঢাকায় স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য প্রায় ১ হাজার ভাড়ার ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হলেও, এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০০টি বরাদ্দ দেওয়া গেছে। ফলে অধিকাংশ মানুষ এখনো অনানুষ্ঠানিক বা নিম্নমানের ঘরে বসবাস করছে। জাতিসংঘের আবাসন সংস্থা ইউএন-হ্যাবিট্যাটের হিসাবে, ঢাকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশই এমন বাসস্থানে থাকে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাজরুল ইসলাম বলেন, সরকার নতুন বস্তি পুনর্বাসন প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করছে এবং সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি আগের অনিয়ম রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবু ঢাকার লাখো মানুষের জন্য এই সংকট এখনই কঠিন ও অবিরাম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় জীবিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা মানুষকে অবিরাম ঢাকামুখী করছে।
অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও দখল হওয়া খালের কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার প্রধান সড়কগুলো ডুবে যায় পানিতে। জলাবদ্ধতা ও বন্যার এই দুরবস্থা প্রতিদিনের জীবনকে টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বসতি দিবস। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে থাকছেন নীতিনির্ধারক, গবেষক ও উন্নয়ন সহযোগীরা। অংশ নিচ্ছেন পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গুইন লুইসসহ আরও অনেকে।
আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে সমন্বিত নগর পরিকল্পনা, টেকসই অবকাঠামো ও সবার জন্য সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা।
ঢাকার জন্য বার্তাটি স্পষ্ট— সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া বস্তিবাসী, দুর্বল পরিবার ও প্রতিদিন শহরে আসা নতুন মানুষেরা থেকে যাবে এক ক্রমবর্ধমান নগর সংকটের সম্মুখভাগে, যেখানে শেষ পর্যন্ত ঝুঁকির মুখে পড়বে মানুষের মৌলিক অধিকার— বাসস্থান।
