কসাই নিয়ে কাড়াকাড়ি!

আগামীকাল (৭ জুন) দেশব্যাপী পালিত হবে ঈদুল আজহা। ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে পশু কোরবানি দেওয়া হয় এই ঈদে। কোরবানির জন্য মুসলমানরা যে যার সামর্থ্যমতো কিনেছেন গরু, ছাগল বা মহিষ।
ঈদের দিন পশু কোরবানি করে চামড়া ছাড়ানো থেকে শুরু করে মাংস কিংবা হাড় কাটার জন্য প্রয়োজন হয় কসাইয়ের। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদে পশুর পর সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে কসাইদের। ছাগল কোরবানি দিলে চামড়া ছাড়িয়ে মাংস প্রক্রিয়াজাত করার কাজ অনেকে নিজেই করে থাকেন পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিয়ে। কিন্তু গরু, মহিষ বা উট কোরবানি দিলে একা এ কাজ করা সম্ভব হয় না। তখন প্রয়োজন পড়ে দক্ষ কসাইয়ের দল।
প্রতি বছর কোরবানির ঈদের তিন দিনে শুধু ঢাকা শহরেই কোরবানি দেওয়া হয় কয়েক লক্ষ পশু। হাটে যথেষ্ট পরিমাণে পশু থাকলেও সবসময়ই অভাব পড়ে কসাইয়ের। অনেকেই এদিন বনে যান এক দিনের কসাই। দক্ষ কসাই কে নিতে পারবে, এ নিয়েও শুরু হয় কাড়াকাড়ি!
পেশাদার কসাই বনাম সিজনাল কসাই
প্রায় ৫০ বছর ধরে কারওয়ান বাজারের মাংসের দোকানে কাজ করেন বাবুল কসাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন চাকরির সন্ধানে। কারওয়ানবাজার এসে তখনকার কসাইদের সর্দার পিয়ারুল কসাইয়ের অধীনে কাজ শিখেছেন। এখনো নিয়মিত দোকানে বসেন বাবুল কসাই। প্রতি কোরবানির ঈদেই তার অধীনে কাজ করা সাগরেদদের নিয়ে কয়েকটি দল গঠন করেন।

সেই দল নিয়ে ঈদের তিন দিন পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় 'গরু বানানোর' কাজ করেন বাবুল কসাই। নতুন করে বায়না খোঁজা লাগে না তার। কারণ প্রতি বছরই নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতা তার ধরা থাকে। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই বাবুল কসাইকে তারা বুকিং দিয়ে রাখেন। ঈদের দিন তিন থেকে চারটি গরু বানায় বাবুল কসাইয়ের একেকটি দল।
বাবুল কসাইয়ের মতে, সবারই উচিত কোরবানির পশুর মাংস পেশাদার কসাই দিয়ে প্রস্তত করা। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "আমরা তিনজন বসলে দুই লাখি (দুই লাখ টাকা দামের) একটা গরু বানাইতে সময় লাগে সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা। আপনি সিজনাল কসাইরে দেন এটা; সকাল নয়টায় গরু ফালাইলেও (কোরবানি দিলেও) বিকালের আগে গোশত চুলায় দিতে পারবেন না।"
এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। বাবুল কসাই বলেন, "ডাক্তার অপারেশন করার সময় জানে যে রোগীর শরীরের কোন মাংসটা কোন দিকে আছে, কোন হাড্ডিটা কীভাবে কাটা লাগে। আমরাও ঠিক তেমন। চামড়া ছাড়ানির পর কোন মাংস কেমনে কাটা লাগে, কোন হাড্ডিতে কীভাবে কোপ দিলে তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করা যায়, আমরা সেটা জানি। বছরের পর বছর প্রতিদিনই তিন-চারটা গরু বানাই আমরা। এখন আমার চোখ বাইন্ধা দিলেও গরু বানায়ে দিতে পারমু।"

তবে পেশাদার কসাই ঢাকা শহরে সর্বোচ্চ হাজার বিশেক আছে বলে জানান বাবুল। লাখ লাখ পশু কোরবানি হয় ঢাকায়। সে তুলনায় পেশাদার কসাইয়ের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। তাই বেশিরভাগ মানুষেরই ভরসা রাখতে হয় সিজনাল কসাইদের ওপর। ঢাকা শহরের রিকশাচালক, সিএনজিচালক, দিনমজুর, দারোয়ানসহ নিম্ন আয়ের মানুষেরা কোরবানির ঈদের সময় সিজনাল কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এতে তাদের অল্প দিনেই ভালো আয় হয়।
এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা মো. শাহজাহান আলী। তিনি প্রতি বছর দু'টি গরু কোরবানি দেন। এবার গরু কেনা হয়ে গেলেও এখনো কসাই ঠিক করতে পারেননি। তিনি বলেন, "আমি প্রতি বছর হাট থেকেই কসাইয়ের সন্ধান শুরু করি। পেশাদার কসাইদের সাথে এবার দামে মিলেনি বিধায় এখনো ঠিক করতে পারিনি। আমার ড্রাইভার জানিয়েছে, সে কসাই ঠিক করে আনবে। সিজনাল কসাইদেরকে দিয়ে কাজ করালে নানারকম সমস্যা হয়। তারা চামড়াটা ঠিকমতো ছাড়াতে পারে না। হাড়গুলোও সাইজমতো কাটতে পারে না। চামড়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভালো দামে বিক্রি করা যায় না।"
সিজনাল কসাইরা অদক্ষ বলে যে পেশাদার কসাইদের থেকে কম খরচে কাজ করেন, বিষয়টি এমনও না। ক্ষেত্রবিশেষে তারা আরো বেশি পারিশ্রমিক নেন। টাকার সাথে চামড়া, মাংসও চান অনেকে। কিন্তু পেশাদার কসাইরা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। মাংস বা চামড়া কখনোই চান না তারা। তবে কেউ খুশি হয়ে মাংস বা ভুঁড়ি দিলে সেটা নেন।

পেশাদার কসাইদের চুক্তি হয় গরুর দামের ওপর ভিত্তি করে। হাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে চুক্তি হয়। অর্থ্যাৎ, গরুর দামের প্রতি হাজার টাকার অনুপাতে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দেওয়া লাগে তাদের। দুই লাখ টাকা দামের গরুতে যদি হাজারে ২০০ টাকা করে চুক্তি হয়, তবে কসাইকে দিতে হবে ৪০ হাজার টাকা। আর ছাগলের জন্য প্রতি ছাগল এক থেকে দুই হাজার টাকা করে দাম রাখা হয়।
সিজনাল কসাইরা এভাবে টাকা নেন না সাধারণত। তারা গরুর আকৃতি দেখে দরদাম করেন। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় কাজ করে দেন তারা। তবে সিজনাল কসাইদের সাথে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে না। পেশাদার কসাইরা নিজেদের সরঞ্জাম দিয়ে কাজ করেন। দা, চাপাতি, ধামা, গাছের গুঁড়ি—এগুলো পেশাদার কসাইরা নিজেরাই নিয়ে আসেন। কিন্তু সিজনাল কসাইদের কাছে বেশিরভাগ সময়েই এগুলো থাকে না।
যারা কোরবানি দিয়ে থাকেন, তারাও অনেক সময় কসাইদের সাথে মাংস কাটায় বা হাড্ডি কোপাতে বসে পড়েন। এতে অনেকটা উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। অনেক তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদেরকে 'এক দিনের কসাই' হিসেবে পরিচিয় দিতে পছন্দ করেন। এটাও কোরবানি ঈদের একটা আনন্দ। অনেক ব্র্যান্ড 'এক দিনের কসাই' লেখা টি-শার্টও বাজারে নিয়ে আসে কোরবানি ঈদের সময়।
ঢাকার বাইরে থেকেও আসে কসাই
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতি বছর পেশাদার আর সিজনাল—দু'ধরনের কসাই-ই আসেন। উত্তরবঙ্গ থেকে বেশি আসেন সিজনাল কসাইরা। মেহেরপুর আর সৈয়দপুর থেকে আসেন পেশাদার কসাই। এমনকি এই ঈদে সৈয়দপুর থেকে বিমানে করে একদল পেশাদার কসাই ঢাকায় এসেছেন বলেও জানা গিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।

ঈদের এক বা দুইদিন আগে তারা বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। আগেই চুক্তি করা থাকে ক্রেতাদের সাথে। কসাইরা ঢাকার বিভিন্ন মেস বা হোটেলে এসে ওঠেন। ঈদের দিন সকাল থেকে কাজ শুরু করেন তারা। ঈদের পরের দিন অনেক মানুষ কোরবানি দিয়ে থাকেন। তখনও কসাইয়ের কাজ করেন তারা।
কাজ শেষ হলে আবার নিজ নিজ জেলায় ফিরে যান। এই দুই-তিন দিনেই তাদের একেকজনের আয় হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। দক্ষ কসাইদের চাহিদা বেশি থাকে সবসময়ই। তাই বেশি দাম দিয়ে দক্ষ ও পেশাদার কসাই ঠিক কার্পণ্য বোধ করেন না সামর্থ্যবানরা।
অনলাইনেও পাওয়া যায় কসাই
আমাদের দেশে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচার প্রথা অনেক আগে থেকেই চালু হয়েছে। তবে কয়েক বছর ধরে অনলাইনে কসাইও পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন ফেসবুক পেজ আছে কসাইয়ের জন্য। ঢাকা কসাই বাড়ি আর কসাই ডট কম এর মধ্যে অন্যতম।
প্রতি বছরই কোরবানির ঈদে এই দুই পেজ থেকে পেশাদার কসাই ঠিক করে থাকেন অনেকেই। এছাড়াও বিক্রয় ডটকমের মতো ওয়েবসাইটে অনেক পেশাদার কসাই নিজেদের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন। সেখান থেকে দামে মিললে কসাই ঠিক করা যায়।
দক্ষ ও পেশাদার কসাইদের সাথে যোগাযোগ থাকে এসব ফেসবুক পেজের। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা কসাই ঠিক করে দিতে পারে। অনলাইনে কসাই ঠিক করলে খরচ একটু বেশি হয়। হাজারে ১৮০ থেকে ২২০ টাকার মতো পড়ে বিভিন্ন পেজের তথ্য অনুযায়ী।
আমাদের দেশের সংস্কৃতি এমন হয়ে গেছে যে কোরবানির ঈদের আনন্দ অনেকাংশ নির্ভর করে ভালো কসাই পাওয়ার ওপরে। ঈদ, কোরবানির পশু আর পশুর মাংস—সবকিছুই ভালো কাটে যদি কসাই ভালো পড়ে। আর কসাই ভালো না পড়লে ঈদের সকাল থেকেই বাড়িতে বাবা-চাচাদের গরম মেজাজ আর রান্নাঘরে মা-চাচীদের মাংস আসার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা—এর মাঝেই কেটে যায় ঈদের দিন।