সিন্ডিকেটের কবলে দক্ষিণ-পশ্চিমের সর্ববৃহৎ চামড়ার বাজার, লোকসানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

সিন্ডিকেটের কবলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার মোকাম রাজারহাট। সরকার নির্ধারিত চামড়ার মূল্য অনুযায়ী, বেশি দামে কিনে পুঁজি হারাতে বসেছেন ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, সরকারের মূল্য নির্ধারণে মাঠ পর্যায়ে তারা বাড়তি দামে চামড়া কিনেছেন। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাড়তি মূল্য দিচ্ছেন না।
অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, 'সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সরকার তো চামড়া কেনে না। ট্যানারি মালিকরা যেভাবে দাম দেবে, সেভাবেই চামড়ার কেনাবেচা করতে হবে।'
আজ মঙ্গলবার (১০ জুন) কোরবানি ঈদপরবর্তী প্রথম হাটে এই চিত্র উঠে এসেছে।
তবে বড়হাট শনিবার হওয়ায় এদিন ব্যবসায়ীরা মূলত বাজার যাচাইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে গরু ও ছাগলের চামড়ার আমদানি ছিল তুলনামূলক বেশ কম।
মঙ্গলবার রাজারহাট ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা স্থানীয় পরিবহনে করে চামড়া এনে স্তূপ করে রেখেছেন। আবার স্থানীয় আড়তদাররা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্তূপ করা চামড়া উলটেপালটে দেখছেন। দাম নিয়ে চলছে দু'পক্ষের দর কষাকষি। আড়তদারদের দামে হতাশা প্রকাশ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাটে কোরবানির পশুর চামড়ার যে দাম, তাতে তারা পুঁজি হারাতে বসেছেন। মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৬০০ এবং বড় চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছাগলের চামড়া দাম প্রতি পিস ২০ থেকে ৩০ টাকা। অথচ মাঠ পর্যায় থেকে তারা এর কমপক্ষে দেড়গুণ ব্যয় করে চামড়া হাটে নিয়ে এসেছেন।
তাদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া। মূলত ট্যানারি মালিক-আড়তদারদের সিন্ডিকেট চামড়ার দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে তারা পুঁজি নিয়েও বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কোলাদিঘলিয়া গ্রাম থেকে ১০০' পিস গরুর চামড়া নিয়ে হাটে এসেছিলেন অলোক বিশ্বাস। তিনি জানালেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করা, লবণ লাগানো এবং পরিবহন খরচ মিলিয়ে চামড়ার দাম প্রতি পিস পড়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেই চামড়া ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকার বেশি দাম উঠছে না। বাধ্য হয়ে এই দামেই করে বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রতিপিস চামড়ায় গড়ে ২০০ টাকা লোকসান গুনেছেন। এর সাথে তার মজুরি খরচও আছে।
অলোক বিশ্বাস জানান, দাম বাড়িয়ে সরকারের চামড়ার মূল্য নির্ধারণের ঘোষণায় গৃহস্থরা মাঝারি আকারের চামড়াও ৫০০-৬০০ টাকার নিচে বিক্রি করতে রাজী
হননি। এই দামে কিনে লবণ, শ্রমিক ও পরিবহণ ব্যয় করে দাম পড়েছে ৮০০-৯০০ টাকা। বেশি দামে চামড়া কিনে এখন তাদের পথে বসার উপক্রম।
রাজারহাটে চামড়া কিনতে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী এসএম শামীম ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকা দামে দু'হাজার পিস চামড়া কিনেছেন। তিনি জানালেন, ট্যানারি মালিকরা যে দামে কিনছেন, সেই হিসাব করেই চামড়া কিনতে হচ্ছে। কারণ চামড়া তো ট্যানারিতেই বিক্রি করতে হবে। ফলে বাড়তি দামে কিনলে লোকসানের আশঙ্কা আছে।
আড়তদার হাসিব চৌধুরী ৫০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকা দরে তিনশ গরুর চামড়া কিনেছেন। তিনি জানালেন, 'সরকার দাম বাড়িয়ে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু সরকার তো আর চামড়া কেনে না। চামড়া কেনে ট্যানারি মালিকরা। তাদের সাথে কথা বলে এই দাম নির্ধারণ করেছে বলে মনে হয় না।'
তিনি আরও বলেন, ট্যানারি মালিকরা যে দাম দিচ্ছে, হাটেও সেই দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে আগামী শনিবার বড় হাট রয়েছে, সেদিন অনেক বড় ব্যবসায়ী, পাইকার ও ট্যানারির প্রতিনিধিরা চামড়া কিনতে হাটে আসবেন। সেদিন বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে।
বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহসভাপতি সাঈদ আহমেদ নাসির বলেন, 'মঙ্গলবার প্রথম ও ছোট হাট হওয়ায় এদিন ছয় হাজারের মতো গরুর চামড়া হাটে উঠেছিল। তবে বাজার বেশ নিম্নমুখী। বেশিরভাগই চামড়াই ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। এতে ছোট ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। মূলত সরকার নির্ধারিত দামের সাথে বাজারের সামঞ্জস্যতা নেই বলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামী শনিবারের হাটের দিকে সবাই তাকিয়ে আছেন। এদিন প্রচুর চামড়া আমদানি যেমন হবে, তেমনি ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ী-আড়তদাররা আসবেন; আবার ট্যানারির লোকজনও আসবেন। কেনা-বেচার প্রতিযোগিতা বাড়লে দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'
ব্যবসায়ীরা জানান, খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার যশোরের রাজারহাট। ঢাকার পরে দেশের অন্যতম বৃহত্তর চামড়ার মোকাম এটি। এই মোকামে তিন শতাধিক আড়ৎ রয়েছে। সপ্তাহে দুইদিন শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। এখানে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর এবং ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচাকেনা করেন।
এই হাট ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার ছোট-বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। প্রতিবছর কোরবানির ঈদ ঘিরে কয়েকটি হাটবারে রাজারহাটে প্রায় শত কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে।