একটি পার্ক, বইয়ের দোকান ও ঢাকার তরুণ প্রজন্ম যেভাবে বদলে দিচ্ছে পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞা

ঢাকার একটি স্কুলের লাইব্রেরিয়ান আদিবা মহসিন। তিনি প্রায়ই অভিজাত এলাকা গুলশানে অবস্থিত বিচারপতি শাহবুদ্দিন পার্কে বইয়ের দোকান বুকওয়ার্মে যান।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন শিশুদের জন্য তেমন কোনো বই ছিল না বলে জানান আদিবা। কিন্তু এখন শিশুদের বইয়ের সৃজনশীলতা ও মান সত্যিই দারুণ বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, "আমি প্রায়ই প্রতিদিনই বুকওয়ার্মে আসি, তাদের নতুন সংগ্রহ দেখি ও আমার সন্তানদের জন্য বই কিনি।"
এরপর আদিবা তার বুকশেলফ থেকে একটি বই নামিয়ে দেখিয়ে বলেন, "দেখুন, এটা কতটা বিরক্তিকর।"
এরপর আদিবা আরেকটি শেলফের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং একটি আকর্ষণীয় পপ-আপ বই বের করে দেখিয়ে বলেন, "এটা দেখুন, এখনকার শিশুরা কী চমৎকার বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, আর তা সম্ভব হয়েছে বুকওয়ার্মের কারণে। এই কারণেই আমি এই দোকানে নিয়মিত আসি। এতে আমার সন্তানের বই পড়া ও শেখার আগ্রহ বাড়ে।"
বুকওয়ার্ম, দেশের অন্যতম প্রিয় স্বতন্ত্র বইয়ের দোকান। এটি পরিচালনা করছেন আমিনা রহমান। এই দোকানটি শুরু করেছিলেন তার শ্বশুর গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমিনা রহমান বলেন, "আমার শ্বশুর ছিলেন একজন প্রাণবন্ত মানুষ। তিনি যুদ্ধবিমান চালালেও তার আসল ভালোবাসা ছিল বই। তিনি কলকাতায় গিয়ে সেখানকার বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে দেখতেন এবং বাংলাদেশেও তেমন কিছু তৈরি করতে চাইতেন।"
প্রায় ১৫ বছর আগে আমিনা রহমান তার শ্বশুরের দোকানে কাজ শুরু করেন এবং এখন তিনিই এটি পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, "বুকওয়ার্মে তখন খুব কম মানুষ আসতেন। তাই আমি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দোকান সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করি। আমরা হোম ডেলিভারিও শুরু করি, যা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আমাদের নাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অনেক সাহায্য করেছে।"
পূর্বের ঠিকানায় লিজসংক্রান্ত জটিলতা থাকার কারণে জায়গাটি ছেড়ে দিতে হয়। ২০২২ সালে বিচারপতি শাহবুদ্দিন আহমেদ পার্কটি সংস্কার করা হলে সেখানে নতুন করে চালু হয় বুকওয়ার্ম।
পার্কে বুকওয়ার্ম চালু হওয়ার পর থেকেই দোকানটিতে আগের তুলনায় মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। একপর্যায়ে আমিনা মজা করে বলেন, তার 'ঘুমকাতুরে বই বিক্রেতা' সাজার নাটক এখন আর চলে না, কারণ দোকানটি এখন বেশ সরগরম ও ব্যস্ত।
শাহাবুদ্দিন পার্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশে পরিণত হয়েছে বুকওয়ার্ম। এটি এখন আর শুধু একটি বইয়ের দোকান নেই, পার্কটিতে আসা শিশু, নারী, শিল্পী, প্রবাসী এবং চিন্তাশীল নানা শ্রেণির মানুষের এক মিলনস্থলে রূপ দিয়েছে।
তবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্কের এই রূপান্তর—ঢাকার অন্যতম সফল ও সবার জন্য উন্মুক্ত এক গণপরিসরে পরিণত হওয়া—কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান 'ফাইভআর সিকিউরেক্স কনসোর্টিয়াম'-এর ব্যতিক্রমধর্মী এক যৌথ উদ্যোগ, যার নেতৃত্বে আছেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও জুনাইদ রহমান। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে এমন একটি নকশা, যা দেখায়—যত্ন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে ঢাকার গণপরিসরগুলো কতটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে।
২০২০ সালে ঢাকার সবুজ পরিসরগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্কের সংস্কার কাজ শুরু করে। এরপর ২০২২ সালে পার্কটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় 'ফাইভআর সিকিউরেক্স'-কে। উদ্দেশ্য ছিল—স্থানটি সবার জন্য উন্মুক্ত ও নিরাপদ রাখা, পাশাপাশি এমন সব অর্থবহ কার্যক্রম যুক্ত করা, যা বিভিন্ন বয়স, আগ্রহ ও আয়ের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
জুনাইদ রহমানের নেতৃত্বে পার্কটি নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পায়। শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, তিনি এই উদ্যোগে হৃদয়ও ঢেলে দিয়েছেন।
জুনাইদ বলেন, "আমাদের কাজ হলো ঢাকাবাসীর জন্য একটি নিরাপদ, উদ্দীপনাময় পরিবেশ এবং কার্যকরভাবে পরিচালিত একটি পার্ক গড়ে তোলা।" বাস্তবেও তাই ঘটেছে—পুনর্নির্মিত পুকুরপাড়ের পথ, শিশুদের খেলার জায়গা, বাস্কেটবল কোর্ট এবং উন্মুক্ত অ্যাম্ফিথিয়েটার—পার্কের প্রতিটি কোণ মানুষকে হাঁটতে, বিশ্রাম নিতে, বই পড়তে এবং একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহিত করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পুরো পরিকল্পনায় অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ থেকে সাবধানতার সঙ্গে বিরত থাকা হয়েছে। জুনাইদ শুরু থেকেই দৃঢ় ছিলেন—পার্কের আত্মা রক্ষা করতে হবে, মুনাফার জন্য সেটিকে বিসর্জন দেওয়া যাবে না। তাই পার্কজুড়ে বিলবোর্ড বা দোকান বসানোর বদলে তাঁরা নিয়েছেন সচেতন সিদ্ধান্ত: যেমন ভালোমানের ক্যাফের জন্য 'নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স' এবং সাধারণ কিছু খেতে চাইলে 'গ্রাম চা'। বিশেষ করে 'নর্থ এন্ড' পার্কের পরিবেশের সঙ্গে অসাধারণভাবে মিশে গেছে—তারা সকাল সকাল খোলে, ফলে মানুষ বারবার এখানে আসেন।
জুনাইদ বলেন, "আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম যে নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূতির জন্য একটি উন্মুক্ত সামাজিক পরিসর তৈরিতে আমাদের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের আগ্রহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু সবার উপরে, আমাদের লক্ষ্য ছিল পার্কটিতে যেন সবাই আসতে পারে।"
বুকওয়ার্ম পার্কের এই দর্শনের বাস্তব উদাহরণ। এটি এখন সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। ছোট ছোট সংগীতানুষ্ঠান 'ঢাকা সেশনস' (যার ধারণা নেওয়া হয়েছে টিনি ডেস্ক থেকে) আয়োজন থেকে শুরু করে ফিলিস্তিন ইস্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে। বুকওয়ার্ম এখন একই মনস্তাত্ত্বিক সমাজবান্ধব মানুষদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
নর্থ এন্ড ক্যাফেতে আমিনা ও জুনাইদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমাদের দেখা হয় লেখক নাভিন মুর্শিদের সঙ্গে। স্কুল থেকে সন্তানকে নিয়ে এসে তিনি পার্কে বিশ্রাম নিতে এসেছেন। নাভিন বলেন, এই পার্ক তার সকালের রুটিনই বদলে দিয়েছে—'এটা শুধু একটা পার্ক নয়। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে নিশ্বাস নেওয়া যায়, হাঁটা যায়, বই পড়া যায়, কিছু খাওয়া বা খেলার সুযোগ থাকে।'
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে, নাভিন উল্লেখ করেন, এই পার্ক ঢাকার আলোচনার ধরনকেই বদলে দিয়েছে। তার ভাষায়, "এই পার্কটিকে যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যেভাবে দোকানগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে—সব কিছু মিলিয়ে এমন এক পরিসর তৈরি করা হয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট মানসিকতা ও আগ্রহের মানুষদের একত্র হওয়া সম্ভব হয়েছে।"
নাভিন বলেন, "বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা এখন আর কেবল একাডেমিক পরিসর কিংবা ব্যক্তিগত পরিবেশে সীমাবদ্ধ নেই। এখানে যেসব আলোচনা হয়, তা স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও চিন্তা উদ্রেককারী। অংশ নিতে উচ্চশিক্ষিত হতে হয় না, কারণ পার্কটি সবার জন্যই উন্মুক্ত।"
শুধু স্থানীয়রাই নয়, বিদেশি দর্শনার্থীরাও পার্কটি নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। লেখক, কূটনীতিক ও পর্যটকেরা প্রায়ই প্রশংসা করেন এই উদ্যোগের। আনজা ক্রিস্টভ (ছদ্মনাম) বলেন, 'আমি নিজ চোখে দেখেছি কীভাবে এই পার্ক সময়ের সঙ্গে বদলেছে। এমন জায়গা প্রতিটি শহরের দরকার—যেখানে মানুষ কোনো চাপ ছাড়াই, বাছ-বিচার ছাড়াই একত্রিত হতে পারে। আমি চাই, ঢাকায় আরও এমন পার্ক গড়ে উঠুক।"
তবে পার্ক যত জনপ্রিয় হচ্ছে, ততই কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে। ভিড় ও যানজট বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—বিশেষ করে আশপাশের অভিজাত মহলের কিছু বাসিন্দার মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
এছাড়া, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল পার্কের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে চাচ্ছে—তারা পার্ককে শুধুই লাভের যন্ত্রে রূপান্তর করতে চায়।
'সব দিক দিয়ে দেখলে, প্রকল্পটি এখন তার নিজস্ব সাফল্যের শিকার,' মন্তব্য করেন জুনাইদ। তিনি বলেন, "আমাদের কাছে এটি একটি কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্যোগ, মুনাফার প্রকল্প নয়। আমি পার্কের দায়িত্ব রক্ষায় অটল থাকব; পার্কের স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দেওয়ার মতো মন আমার নেই।"
এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জুনাইদ ও তার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানকে বেশ কিছু স্নায়ুক্ষয়ী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সে সময়ের ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের প্রবল চাপের মুখেও জুনাইদ ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ৫ আগস্টের মাত্র ক'দিন আগেই পার্কের অ্যাম্ফিথিয়েটারে উন্নয়নকর্মীদের একটি প্রতিবাদ সভায় সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর জেরেই যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে একটি ভ্রমণ সতর্কতা জারি করা হয়। ঘটনাটি ছিল ধাক্কাস্বরূপ, কিন্তু তাতেও তারা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জনগণের মুক্ত পরিসরে মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার অবস্থান থেকে পিছু হটেননি।
জুনাইদ বলেন, "এই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও গভীর করে তুলেছে—এই পার্ক এখন দেশের তরুণদের চেতনা এবং জুলাই অভ্যুত্থানের স্পৃহাকে ধারণ করে। আপনি শাহাবুদ্দিন পার্কে আসলেই দেখবেন, সবচেয়ে বড় সংখ্যক দর্শনার্থী তরুণরা। ঢাকার এই তরুণ বাসিন্দারাই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। তারা এমন এক বাংলাদেশ ও ঢাকা চায়, যেখানে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়বে না। তারা দায়িত্ব নিতে চায়, তারা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ইতিবাচক অবদান রাখতে চায়।"
জুনাইদ ও আমিনার সবচেয়ে বড় উপলব্ধি—ঢাকাবাসী স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে, তারা আর কোনোভাবেই উন্মুক্ত গণপরিসরে প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ রাখতে দেবে না।
আমিনা বলেন, "এই পার্কের প্রাণ হচ্ছে জনগণের অবাধ প্রবেশাধিকার। আমরা আমাদের কমিউনিটির জন্য ভালো কিছু করতে চাই, আর ঢাকাকে যদি আমরা একটি অগ্রসর সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে এর জন্য এমন উন্মুক্ত জায়গাগুলোর খুব প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, "যখন একদল মানুষ একত্রিত হয়ে একটি সাধারণ মূল্যবোধ ভাগ করে নেয়, তখন জাদুকরী কিছু ঘটে যায়। এই পার্কেও এমন কিছু জাদুকরী বিষয় ঘটছে—এবং এটিকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।"