‘সাগর থেকে শিখরে’—কক্সবাজার থেকে হেঁটে শাকিলের এভারেস্ট যাত্রা হলো শুরু

খেলাধুলায় ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। শৈশব-কৈশোর কেটেছে অসম্ভব দুরন্তপনায়। এক সময় ঠিকই করে ফেলেছিলেন, হবেন ক্রিকেটার। কিন্তু সেসব না হয়ে এমন এক খেলায় নাম লেখালেন, যেখানে জীবন-মৃত্যুর দূরত্ব কেবল একটি ভুল পদক্ষেপ!
ইকরামুল হাসান শাকিল একজন পর্বতারোহী। ছোট-বড় অসংখ্য পর্বত আরোহণ আর অভিযানের পর এবার এভারেস্ট শিখর ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে তার। তবে যেন-তেনভাবে নয়, রীতিমতো বিশ্ব রেকর্ড গড়েই চড়তে চান বিশ্বের সর্বোচ্চ এই শৃঙ্গে!
'সি টু সামিট' নামের চ্যালেঞ্জে কক্সবাজার থেকে হেঁটে মাত্র ৯০ দিনে এভারেস্ট জয় করার সংকল্প শাকিলের। এ সময় তিনটি দেশের মধ্যে দিয়ে মোট ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবেন তিনি। এরপর চড়বেন ২৯ হাজার ৩১ ফুট উঁচু এভারেস্টে!
'মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়'
জীবনের বেশিরভাগ সময় গ্রামে কেটেছে শাকিলের। কলেজে পড়তে প্রথম তার ঢাকায় আসা। তখন একের পর এক এভারেস্ট জয় করছেন বাংলাদেশী পর্বতারোহীরা। ২০১১ সালে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন এম এ মুহিত। দেশের প্রথম নারী হিসেবে পরের বছর এভারেস্ট আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। খবরগুলো আলোড়িত করে শাকিলকে। তখন তিনি জানতে পারেন, পর্বতারোহণও একটি স্পোর্টস। আর তাতেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার শৈশবের সেই খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন!
এরপরই তার বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের সদস্য হওয়া। এম এ মুহিতের সহযোগিতায় এই ক্লাবের মাধ্যমেই শুরু হয় পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ। ২০১৪ সালে ভারতের নেহেরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকে মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন শাকিল। পরের বছরই নেমে পড়েন অভিযানে, জয় করেন মাউন্ট কেয়াজো-রি। ২০১৮ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ পান তিনি। পরের বছর নেপালের হিমলুং জয় করেন, যার উচ্চতা প্রায় ২৩ হাজার ৩৮০ ফুট।
পর্বতারোহণের পাশাপাশি নানা ধরনের অভিযানও করেছেন শাকিল। কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসা প্রথম ব্যক্তি তিনি! কোভিডের সময় যখন অচলাবস্থা সর্বত্র, তখন পরিকল্পনা করেন বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রেকিং পথ 'গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল' জয়ের। দেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সেবার ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার পাড়ি দেন ১০৯ দিনে, যা এখন পর্যন্ত করতে পেরেছেন মাত্র ৩৩ জন।
এতসব করার পর এই পর্বতারোহীর পরবর্তী লক্ষ্য মাউন্ট এভারেস্ট। তবে এখানেও ব্যতিক্রম কিছু করার কথা ভাবছেন তিনি। তাতেই জন্ম 'সি টু সামিট' পরিকল্পনার!

'সাগর থেকে শিখরে'
অস্ট্রেলিয়ার পর্বতারোহী টিম ম্যাকার্টনি-স্নেপ দ্বিতীয়বার এভারেস্ট জয়ের আগে অন্যরকম এক পরিকল্পনা করেন। সমুদ্র থেকে হেঁটে সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তিনি। সালটা ১৯৯০। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের গঙ্গাসাগর থেকে হাঁটা শুরু করেছিলেন টিম। ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এভারেস্ট জয় করতে তার সময় লেগেছিল ৯৬ দিন।
টিমের এই রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়ার ইচ্ছা ইকরামুল হাসান শাকিলের। সে লক্ষ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্র সৈকত থেকে হাঁটা শুরু করেছেন তিনি। তিনটি দেশের মধ্যে দিয়ে মোট ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দেবেন তিনি, তাও মাত্র ৯০ দিনে—যা ভেঙ্গে দেবে টিম ম্যাকার্টনির রেকর্ড। অভিযানের সময় টিমের বয়স ছিলো ৪৫ বছর। সফল হলে সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে সমুদ্র থেকে হেঁটে এভারেস্ট জয় করার বিশ্বরেকর্ড গড়বেন শাকিল।
টানা ১২ দিন হেঁটে শাকিল এখন ঢাকায়। ঢাকার সায়দাবাদ থেকে পরবর্তী যাত্রা শুরু করবেন শুক্রবার (১৪ মার্চ)। জানালেন, এই অভিযানে সফল হলে পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে 'গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল' এবং 'সি টু সামিট' সম্পন্ন করবেন তিনি! সমুদ্রের জল স্পর্শ করার পর চূড়া পর্যন্ত প্রতিটা জায়গায় তার পায়ের চিহ্ন থাকবে, এটাই তার পরিকল্পনা।
পায়ে হেঁটে দীর্ঘ অভিযানগুলো বেশ উপভোগ করেন বলে জানালেন শাকিল। এবারের যাত্রার বাংলাদেশ অংশে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই যুক্ত হচ্ছেন তার সঙ্গে। ভারত ও নেপালে হাঁটতে হবে একাই।
শাকিল জানালেন, তার যাত্রা শুরু হয় খুব ভোরে। ঘুম থেকে উঠেই হাঁটতে শুরু করেন। সারাদিন হাঁটেন। যেখানে যা খাবার পাওয়া যায়, সেগুলো খেয়েই চলতে থাকেন পথ। সন্ধ্যায় হাঁটা থামিয়ে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করতে হয়। এখন অবধি পরিচিত বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটিয়ছেন। বললেন, বাকিপথটুকুও কেটে যাবে এভাবেই।

প্রকৃতি রক্ষাও লক্ষ্য
এই পুরো যাত্রাপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন শাকিল। চলতে চলতে মানুষের মাঝে দুটি বার্তা দিয়ে যাবেন তিনি। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক ব্যবহার এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার আহ্বান জানাবেন সবাইকে।
পর্বতারোহী ছাড়াও শাকিলের আরও দুটি পরিচয় রয়েছে। তিনি লেখন এবং নাট্যকর্মী। জানালেন, নিজের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই প্রকৃতি রক্ষায় সবসময় সরব তিনি। তবে এবার জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে এ দায়িত্ব দিয়েছে তাকে। তিনি এই সংস্থার 'ইয়ুথ অ্যাডভোকেট' নির্বাচিত হয়েছেন।
"আমি ২০১৫ সাল থেকে মানুষকে প্লাস্টিক নিয়ে সচেতন করি। সব জায়গায় আসলে প্লাস্টিক দূষণ। সমুদ্র, পাহাড়, এমনকি হিমালয় গিয়েও প্লাস্টিক দূষণ দেখেছি। এই বিষয়টা নিয়েই মানুষকে সচেতন করবো। তাছাড়া, আমার যাত্রাটা তো পায়ে হেঁটে। এতে কোনো কার্বণ নিঃসরণ হচ্ছে না, এ ব্যাপারটি নিয়েও কথা বলবো মানুষের সাথে। ইউএনডিপিকে প্রস্তাব দেওয়ার পর তারাও রাজি হয়। তারা আমাকে ইয়ুথ অ্যাডভোকেট হিসেবে নিযুক্ত করেছে," বললেন শাকিল।
মানুষের মাঝে প্রকৃতি রক্ষার বার্তা পৌঁছে দেওয়াটা এভারেস্ট জয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে করেন না শাকিল। সেজন্য যে জায়গাতেই তিনি যাবেন, পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিই থাকবে তার লক্ষ্য। এই যাত্রায় তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকার কথা জানিয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ—যারা প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারে রয়েছে শীর্ষস্থানে। তার স্ন্যাকস পার্টনার হিসেবে থাকছে 'মিস্টার নুডলস'।

বড় চ্যালেঞ্জ 'অর্থ'
কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসতে ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন শাকিল। সামনে পড়ে রয়েছে বিশাল পথ। জানালেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০ থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে তিনি এভারেস্ট বেসক্যাম্পে পৌঁছাবেন। সম্ভাব্য সামিট ডেট ২০ মে। পরিবেশ ভালো থাকলে নির্দিষ্ট সময়েই অভিযান শেষ করতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি।
তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সমস্যা অর্থ। বললেন, "আমার অভিযানের তিন ভাগের এক ভাগ টাকা এখনও বাকি আছে। সেটা কিন্তু অল্প না, ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কেনা যায় এমন। এই টাকা কোথা থেকে আসবে আমি জানি না! কিন্তু আমি লেগে আছি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লেগে থাকবো।"
শাকিল আরও জানালেন, ডাক্তার বলেছেন বিশ্রাম করতে হবে। কিন্তু বিশ্রামের সময় তো নেই। গত নভেম্বর থেকে স্বাভাবিক ঘুম নেই তার!
"যেদিন শুরু করলাম, সারারাত বাস জার্নি করে কক্সবাজার গিয়েছি। বাসে তো ঘুমানো যায় না। সকালে ইনানী থেকে হাঁটতে শুরু করেছি, এখন পর্যন্ত না আছে ঘুম, না আছে বিশ্রাম!," যোগ করলেন শাকিল।

শাকিল হতে হলে
একজন শাকিল হতে এই মানসিক ও শারীরিক দৃঢ়তাই সবচেয়ে বেশি দরকার বলে মনে করেন তিনি। "পর্বতারোহী হতে হলে শারীরিক সক্ষমতা আর মানসিক শক্তি অবশ্যই থাকতে হবে। এটা তৈরি করা যায়। সবচেয়ে বেশি দরকার মানসিক শক্তি। অনেক বাধা আসবে পরিবার, সমাজ থেকে। এই বাধাটা অতিক্রম করার মতো মানসিকতা থাকতে হবে," বললেন শাকিল।
'সি টু সামিট' এর মতো অভিযানের জন্যও ইচ্ছাশক্তিকে সবচেয়ে বড় সহায়ক বলে মনে করেন তিনি। কেউ যদি এ ধরনের উদ্যোগ নিতে চান, তাহলে তাকে দীর্ঘ একটা সময় ধরে নিজেকে তৈরি করতে হবে। থাকতে হবে সঠিক পরিকল্পনা।
শাকিলের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এবার পালা তা বাস্তবের রূপ দেওয়ার। সে লক্ষ্যেই শুক্রবার আবারও যাত্রা শুরু করবেন তিনি। জানালেন, সব ভয় তিনি জয় করেছেন। "আমি পর্বতারোহী হতে চেয়েছি। আমি এভারেস্ট থেকে নাও ফিরতে পারি। আমার পরিবারও সেটা জানে। তবে আমার কোনো ভয় করছে না! আমি আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছি। এ অবস্থায় মৃত্যু হলেও সেটা সম্মানের হবে। দেখা যাক কী হয়," শেষ করলেন শাকিল।