কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া নেপালের ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ মানাসলুতে প্রথম বাংলাদেশি বাবর
বাংলাদেশের পর্বতারোহণ ইতিহাসে নতুন এক মাইলফলক স্থাপন করলেন ডা. বাবর আলী। নেপালের মানসিরি হিমাল পর্বতশ্রেণিতে অবস্থিত বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মানাসলু (৮,১৬৩ মিটার বা ২৬,৭৮১ ফুট) জয় করেছেন তিনি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্য ছাড়াই এ ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত চূড়ায় আরোহণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই এত উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ জয় করলেন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরে তিনি মানাসলুর শীর্ষে পৌঁছান। এটি বাবর আলীর আরোহণ করা চতুর্থ ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ।
একই দিনে মানাসলুর চূড়ায় সফলভাবে আরোহণ করেন আরেক বাংলাদেশি পর্বতারোহী তানভীর আহমেদও। এটি ছিল তার প্রথম ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ এবং প্রথম অভিযানেই তিনি এই সাফল্য অর্জন করেন।
'ভার্টিক্যাল ড্রিমারস' নামের পর্বতারোহণ ক্লাবের উদ্যোগে এই অভিযানের শিরোনাম ছিল 'মানাসলু এসেন্ড: ভার্টিক্যাল ডুও'।
শনিবার (৪ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে এই অভিযানের সমাপ্তি উপলক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলন এবং পতাকা হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে দুই পর্বতারোহী ছাড়াও স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সামুদা গ্রুপের প্রধান ব্যবসায়িক কর্মকর্তা বিকাশ কান্তি দাস এবং ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ নূর ফয়সাল। বিকাশ কান্তি দাস বলেন, 'বাংলাদেশি তরুণ ক্রীড়াবিদদের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে সামুদা এই উদ্যোগে সামিল হয়েছে।'
ভার্টিক্যাল ড্রিমারসের জনসংযোগ সম্পাদক আশরাফুল আরেফিন আসিফ বলেন, 'একই দিনে আমাদের দুই পর্বতারোহী লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে মানাসলুর শীর্ষে পৌঁছেছেন। এটি জাতির জন্য এক বিরাট গর্বের মুহূর্ত। বাবর এবং তানভীর দেখিয়েছেন, পর্বতারোহণেও বাংলাদেশ অসাধারণ কীর্তি অর্জন করতে পারে। ভবিষ্যতে আমরা তাদের কাছ থেকে আরও বড় সাফল্যের আশা রাখি।'
এর আগে এভারেস্ট, লোৎসে ও অন্নপূর্ণা-১ জয় করা বাবর আলী দীর্ঘ দিন ধরে অক্সিজেন ছাড়া ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত আরোহণের স্বপ্ন দেখছিলেন।
তিনি বলেন, 'পশ্চিমা পর্বতারোহীরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হিমালয়ের চূড়া জয় করতেন, তখন আমরা গৃহবন্দি জাতি হিসেবে পরিচিত ছিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল, আমরাও যে এমন কীর্তি অর্জন করতে পারি, তা প্রমাণ করা। এটা শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, প্রতিবারই এটি দেশের পতাকা আরও উঁচুতে তুলে ধরে।'
তরুণ পর্বতারোহীদের আরও ভালো প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'অক্সিজেন ছাড়া আরোহণ করা কোনো খেয়ালের বশে হয় না। এর জন্য বছরের পর বছর অনুশীলন, নিয়মানুবর্তিতা এবং ধৈর্যের প্রয়োজন। আমার লক্ষ্য হলো বিশ্বের সবকটি, অর্থাৎ ১৪টি ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করা। যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমি বিশ্বাস করি, বাকি ১০টি চূড়ায়ও আমাদের দেশের পতাকা নিয়ে যেতে পারব।'
বিদেশে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেওয়া অধিকাংশ বাংলাদেশি ৮ হাজার মিটার পর্বতারোহীর বিপরীতে তানভীর আহমেদ তার সাফল্য অর্জন করেছেন মূলত অনুশীলন, নিয়মানুবর্তিতা এবং স্থানীয় প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভর করে। তানভীর বলেন, 'আমাদের দেশে যেহেতু কোনো হিমবাহ বা বড় পর্বত নেই, তাই আমার আনুষ্ঠানিক পর্বতারোহণ শিক্ষার অভাব ছিল। তবে দৃঢ় সংকল্প, নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং আমার ক্লাবের সহায়তায় আমি সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পেরেছি।'
৮ হাজার মিটার উচ্চতায় হালকা বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াকে তানভীর তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, 'এত উচ্চতায় এটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা, কিন্তু আমার প্রস্তুতি আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এখন আমি অন্যান্য উঁচু পর্বতশৃঙ্গ জয়ের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি।'
এ দুই পর্বতারোহী গত ৫ সেপ্টেম্বর নেপালে পৌঁছান এবং মানাসলু বেস ক্যাম্প পর্যন্ত পাঁচ দিনের ট্রেকিং করেন। ক্যাম্প ৩ পর্যন্ত উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কয়েকবার আরোহণের পর তারা ২২ সেপ্টেম্বর চূড়ার দিকে চূড়ান্ত আরোহণ শুরু করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারা ক্যাম্প ৪ (৭,৪০০ মিটার)-এ বিশ্রাম নেন এবং রাতে চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরের মধ্যে তারা দুজনই সফলভাবে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মানাসলুর চূড়ায় যেতে সক্ষম হন।
বাবর আলী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস গ্র্যাজুয়েট। তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা এবং 'ভার্টিক্যাল ড্রিমারস'-এর সাধারণ সম্পাদক। তানভীর আহমেদ ভিএফ এশিয়া বাংলাদেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এবং ক্লাবের পর্বতারোহণ বিষয়ক সম্পাদক। কিশোরগঞ্জের এই বাসিন্দা বাবর আলীকে অনুসরণ করে ২০২৩ সালে নেপালের আমা দবলাম জয় করেছিলেন।
দুজনের এই সাফল্য বাংলাদেশের পর্বতারোহণ ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করেছে এবং একইসঙ্গে দেশের গৌরবকে আরও উঁচু করেছে।
