কক্সবাজার থেকে এভারেস্ট: যেভাবে ৮৪ দিনে ‘সি টু সামিট’ অভিযান সম্পন্ন করলেন শাকিল

অসাধারণ সাহস, সহনশীলতা ও সংকল্পের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইকরামুল হাসান শাকিল। কক্সবাজারের ইনানি সৈকত থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র ৮৪ দিনে পৌঁছে গেছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখর মাউন্ট এভারেস্টে—গড়েছেন অনন্য এক রেকর্ড।
'সি টু সামিট' নামে পরিচিত এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে অভিযান শেষ করা। কিন্তু নিজের নির্ধারিত সময়সীমার আগেই ৮ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার উঁচু শিখরে উঠে সপ্তম বাংলাদেশি হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান শাকিল।
তবে এই অভিযান শুধুই শারীরিক দক্ষতার পরীক্ষা ছিল না—ছিল পরিবেশবাদী বার্তা ছড়ানোর এক দৃঢ় প্রচেষ্টা।
২৫ ফেব্রুয়ারি, ইনানিতে প্লাস্টিক দূষণে জর্জরিত সৈকতের পাড় থেকে যাত্রা শুরু করেন শাকিল। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল পেরিয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে অবশেষে ১৯ মে ভোরে পৌঁছে যান এভারেস্ট শৃঙ্গে।
এক আবেগঘন ফেসবুক পোস্টে শাকিল লেখেন, 'এ পথ সহজ ছিল না। হিমালয়ের অতল গভীর বরফের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আমাদের জীবনবিন্দু। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য।'

খুম্বু আইসফল থেকে হিলারি স্টেপ—অক্সিজেনশূন্য অঞ্চল পেরিয়ে সরু শৃঙ্গপথে বারবার থমকে যেতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু মাতৃভূমির টান ও অভিযানের উদ্দেশ্যই এগিয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়েছে।
'সি টু সামিট' ছিল মূলত এক সতর্কবার্তা: পৃথিবীকে আমাদের রক্ষা করা দরকার। শাকিল বলেন, 'আমাদের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে সমুদ্র থেকে পর্বতশৃঙ্গ পর্যন্ত আমাদের প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে।'
যেখান থেকে যাত্রা শুরু, সেই কক্সবাজারের সৈকতেই প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রকোপ প্রকট। সেখান থেকেই পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
শাকিলের কাছে পর্বতারোহণ কেবল অ্যাডভেঞ্চার নয়—এটা দায়িত্ব, প্রতিবাদ ও প্রতিজ্ঞা। তিনি বলেন, 'আমরা যদি এভারেস্ট জয় করতে পারি, তবে নিজের ভেতরের অসচেতনতাও জয় করতে পারব।'
শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করেন, এই সাফল্যের ওজন কেবল তার একার নয়—এটা তার দেশ, জনগণ এবং প্রতিটি স্বপ্নবাজ মানুষের।
অভিযানসঙ্গী ও বন্ধু তাশি গ্যালজেন শেরপার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শাকিল। চলতি মৌসুমে তাশি ইতোমধ্যে তিনবার এভারেস্ট জয় করেছেন, এবং এবার চতুর্থবারের মতো চেষ্টা করছেন। বহুদিন ধরে তারা একসাথে রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন দেখতেন—এবং সেটিই বাস্তব হয়েছে। শাকিল তার অভিযান শেষ করলেও তাশির যাত্রা এখনো চলছে।
নতুন রেকর্ডের সূচনা
বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম উল হক জানান, ১৯ মে সকাল ৬টায় শাকিল এভারেস্ট জয় করেন। শাকিলের ৮৪ দিনের হেঁটে যাত্রা অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যাকহার্টনি-স্নেইপের ১৯৯০ সালের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। সেই সময়ে স্নেইপ ভারতের গঙ্গাসাগর থেকে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার হেঁটে তিন মাসের বেশি সময় নিয়ে শিখরে পৌঁছান।
তবে শাকিলের জন্য এটি কেবল শুরু। শাকিল লেখেন, 'সি টু সামিট' শুধু একটি অভিযান নয়—এটি একটি বিপ্লব, একটি জাগরণ।
তিনি বলেন, 'আমরা এখনই যদি কিছু না করি, তবে হয়তো এমন দিন আসবে যখন এভারেস্ট থাকবে না, থাকবে না চলার পথ, থাকবে না নিঃশ্বাস নেওয়ার বাতাসও।'
ইকরামুল হাসান শাকিলের এই পথচলা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এক প্রেরণা। সাহস, বিশ্বাস ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকলে কোনো শৃঙ্গই জয় করা অসম্ভব নয়—এই বার্তাই যেন দিলেন তিনি।