চট্টগ্রামের বাতাস ও পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

চট্টগ্রামের আকাশ, নদী ও ভূগর্ভস্থ পানি—সব জায়গায় এখন দূষণের ছাপ। শহরের মানুষ প্রতিদিন শ্বাস নিচ্ছে দূষিত বাতাসে আর পান করছে ভারী ধাতু ও রাসায়নিক মিশ্রিত পানি।
গবেষণা বলছে, দূষণের কারণে চট্টগ্রামের মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ছয় বছর। প্রতিদিন হাজারো মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা, অকালমৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন।
শুধু বাতাস নয়, কর্ণফুলী নদীর পানিতেও দূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। নগরের টিউবওয়েলের পানিতে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সীসা ও ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ অনুমোদিত মানের কয়েক গুণ বেশি পাওয়া গেছে। নগরীর ডাম্পিং স্টেশনগুলোর আশপাশের পানিতে বিপজ্জনক মাত্রার নাইট্রেট ও অ্যামোনিয়া শনাক্ত হয়েছে। শিল্প ও বন্দরনগরী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম এখন নাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) চট্টগ্রাম সমন্বয়ক মুনিরা পারভীন রুবা টিবিএসকে বলেন, "এখানে প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না, অনেক সময় অদক্ষ কর্মকর্তাদের পরিবেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবার রাজনৈতিক প্রভাবও বড় সমস্যা।"
"ক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা পরিবেশকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করেন। তাছাড়া সাধারণ মানুষও অনেকটা উদাসীন। যথাযথ আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা ছাড়া পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়," বলেন তিনি।
গবেষকরা বলছেন, নগর ও শিল্পাঞ্চলের অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি এবং শিল্প ও বন্দর কার্যক্রম থেকে নির্গত দূষণই চট্টগ্রামের পরিবেশ সংকটের মূল কারণ। প্লাস্টিক বর্জ্য, ল্যান্ডফিল ও ডাম্পিং স্টেশন থেকে নির্গত তরল ও কঠিন বর্জ্য ভূগর্ভস্থ পানি ও নদী দূষণ করছে। প্রশাসনিক অদক্ষতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নাগরিক অসচেতনতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
বর্জ্যে দমবন্ধ নগরীর
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, অর্থনীতি ও মার্কেটিং বিভাগের একদল গবেষক এবং বিশ্বব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে ৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ বছরে প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার ৮৩৩ মেট্রিক টন যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় নালা, নর্দমা, খাল ও জলাশয়ে জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে এবং কর্ণফুলী নদীতে মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে। এটি মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ২৭ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কর্ণফুলী নদীর ২ থেকে ৭ মিটার গভীরতায় প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য জমে আছে—যা ড্রেজিং কার্যক্রমে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নগরে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২ হাজার ২০০ টন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় আসে। বাকি বর্জ্য ফেলা হয় রাস্তা, নালা ও খালে। এর ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা এবং নদী ও সাগরে দূষণ ছড়াচ্ছে।

বায়ুদূষণে দেশের মানুষের আয়ু কমছে পাঁচ বছরের বেশি
বাংলাদেশের বাতাসে ক্ষতিকর সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম২.৫) মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার প্রায় ১৫ গুণ বেশি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) ২০২৫ সালের এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলএই) অনুযায়ী, এ দূষণের কারণে দেশের একজন মানুষের গড় আয়ু কমছে প্রায় পাঁচ বছর ছয় মাস।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। এই দুই নগরের বাসিন্দাদের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ছয় বছর। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী পরিষ্কার থাকত, তবে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন প্রত্যাশা কয়েক বছর পর্যন্ত বাড়ত। কিন্তু বাস্তবে দূষিত বাতাস এখন শহরাঞ্চলে মানুষের গড় আয়ু চার থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে।
১৯৯৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সূক্ষ্ম ধূলিকণার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার–এর গবেষণা অনুযায়ী, কেবল সূক্ষ্ম ধূলিকণার কারণেই প্রতিবছর প্রায় এক লাখ দুই হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে, যার মধ্যে পাঁচ হাজারেরও বেশি শিশু।
বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর ৪৮ শতাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাসিন্দা। দূষিত বাতাসে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুস ক্যান্সার এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণজনিত অসুস্থতায় বছরে প্রায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এছাড়া দূষণের কারণে বছরে প্রায় ২৬ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ভূগর্ভস্থ পানিতেও দূষণ
শুধু বাতাস নয়, চট্টগ্রামের ভূগর্ভস্থ পানিতেও বিপদ বাড়ছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) গবেষকরা ২০২৩ সালে নগরের ১১৭টি ভূগর্ভস্থ পানির নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, টিউবওয়েলগুলোর পানিতে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ ও ক্যাডমিয়ামের মাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে বেশি। বিশেষ করে অগভীর কূপগুলোতে এই ধাতুগুলোর ঘনত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে। যদিও ক্রোমিয়াম, কপার ও জিঙ্কের মাত্রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সীমার মধ্যে ছিল।
গবেষকরা সতর্ক করেছেন, দীর্ঘদিন এই পানি পান করলে কিডনি ও লিভারের জটিলতা বাড়তে পারে, পাশাপাশি ক্যান্সারের ঝুঁকিও রয়েছে। তাদের মতে, স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত পানি পরীক্ষা ও নিরাপদ পানীয় সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের ল্যান্ডফিল এলাকার আশপাশের ভূগর্ভস্থ পানিতে নাইট্রেট ও অ্যামোনিয়ার মাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে অগভীর কূপগুলোতে এই দূষণ ভয়াবহ মাত্রায়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ল্যান্ডফিল থেকে নির্গত তরল বর্জ্য ও ক্ষারীয় পদার্থ পানিতে মিশে দূষণ তৈরি করছে। এতে ওই এলাকার পানি ব্যবহার বা পান করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিশুরা ক্যাডমিয়াম দূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়াম একসঙ্গে ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।
গুরুতর দূষণ ঝুঁকিতে কর্ণফুলী নদী
চট্টগ্রামের প্রধান নদী ও পানীয় জলের উৎস কর্ণফুলী নদীও রক্ষা পায়নি দূষণের কবল থেকে। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দখল ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে নদীটি এখন গুরুতর হুমকির মুখে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য কর্ণফুলীতে মিশছে। এসব বর্জ্যের সঙ্গে মিশছে ৫ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা, যা মাছ, কাঁকড়া ও শামুকের শরীরে ঢুকে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের দেহেও পৌঁছাচ্ছে।
দখলও কর্ণফুলীর বড় সমস্যা। ১৯৯০ সালে ব্রিজঘাট এলাকায় নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫১০ মিটারে। নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে দুই হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা—উত্তর পাড়ে প্রায় দুই হাজার ও দক্ষিণ পাড়ে পাঁচ শতাধিক।
কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের জন্য প্রতিদিন প্রায় ২৮ কোটি লিটার পানীয় জল সরবরাহ করে। গবেষকরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকমুক্ত নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরীক্ষা ও নদী রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ইকবাল সরোয়ার টিবিএসকে বলেন, "এককভাবে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নগরবাসী, প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, সিডিএ ও ওয়াসাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ঘাটতি রয়েছে। জনসচেতনতা বাড়ানো ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোই এখন সময়ের দাবি।"
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, "মাইক্রোপ্লাস্টিক ত্বকের রোগ, শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা ও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। কর্ণফুলীতে প্লাস্টিক প্রবেশ রোধ করতে হবে, কারণ এ নদীই শহরের পানীয় জলের মূল উৎস। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না হলে ভবিষ্যতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে।"
কৃষিজমিতেও ভারী ধাতুর ভয়
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড অঞ্চলের শিপইয়ার্ডের আশপাশের কৃষিজমিতে ভারী ধাতু দূষণ ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১ সালের এক গবেষণায় ১৯টি কৃষিজমির মাটির নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব জমিতে সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, তামা, জিঙ্ক ও নিকেলের মাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি।
এই ধাতুগুলোর কারণে মাটির মাইক্রোবায়াল জীববৈচিত্র্য ও এনজাইম কার্যক্রম মারাত্মকভাবে কমে গেছে, বিশেষ করে ডিহাইড্রোজিনেস, ইউরিয়েজ, অ্যাসিড ফসফাটেজ ও অ্যারিলসালফাটেজ এনজাইম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কৃষিজমির উর্বরতা ও ফসল উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
গবেষকরা সতর্ক করেছেন, এ অঞ্চলে ভারী ধাতু দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানো জরুরি। এতে কৃষিজমির স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি উভয়ই কমানো সম্ভব হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর পরিচালক সোনিয়া সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "এটা শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সলিড ওয়েস্টের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের, আর আমরা শিল্পবর্জ্য তদারকি করি। নিয়মিত মনিটরিং, জরিমানা, ক্ষতিপূরণ ও মামলা পরিচালনা করে যাচ্ছি, তবে জনবল ও গবেষণাগার সীমাবদ্ধতার কারণে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, "সলিড ওয়েস্ট চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম বড় সমস্যা। অনেক এলাকায় সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনই নেই। বিষয়টি আমরা তাদের জানিয়েছি। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।"
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, "সিটি করপোরেশন প্রতিদিন গৃহস্থালির প্রায় ২,২০০–২,৪০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করছে। তবে শিল্পনগরী হিসেবে চট্টগ্রামে বিপুল শিল্পবর্জ্য নদীতে পড়ছে, যা আমাদের আওতার বাইরে। অনেক নাগরিকও বর্জ্য ড্রেন ও খালে ফেলে দিচ্ছেন, এতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ বাড়ছে। শতভাগ বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।"