জামায়াতের রাজনীতিতে একাত্তরের চরিত্র আবার ফুটে উঠেছে: ইকবাল হাসান মাহমুদ
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ (টুকু)। চার দলীয় জোট সরকারের সময় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন সংসদ সদস্য। সম্প্রতি দেশের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট আকরাম হোসেন।
টিবিএস: চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: আমি প্রফেসর ইউনূসের লন্ডন সফরে নির্বাচনের প্রসঙ্গে ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা গত ১৬ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেই ফ্যাসিস্ট দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে এবং এর পর ডা. ইউনূসকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তার মূল লক্ষ্য নির্বাচন করে ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। দেরি হয়েছে, কিন্তু যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারির জন্য রোডম্যাপ দিয়েছে, তাই নির্বাচন হওয়াটা কাম্য।
দেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে; প্রশাসন কার্যকর নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকমতো কাজ করছে না; দেশ মোটামুটি অচল হয়ে আছে। এই অচলতা কাটাতে হলে একটি নির্বাচিত সরকার থাকতে হবে। জনগণের কাছে সেই সরকারের কমিটমেন্ট থাকতে হবে। এদিকে নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য দেশে অনেক অগণতান্ত্রিক শক্তি সক্রিয় — এরা বহুভাবে ধর্মের নাম নিয়ে রাজনীতি করে। এরা নির্বাচন বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে, আবার সারাদেশে প্রার্থীও দিয়েছে। তারা ডাবল স্ট্যান্ড গেম প্লে করছে, এটা তারা অতীতেও করেছে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ইন্সটিটিউশনাল ক্রাইসিস দেখা গেছে; ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র প্রণয়ের পর ১৯৫৮ সালের নির্বাচনের ব্যবস্থা হয় এবং তখন সবাই নির্বাচনমুখী হয়ে ওঠে। যে দলটি এ মুহূর্তে লাফালাফি করছে, তাদের নেতা তখন লাহোরে দাঙ্গা করায় দশ হাজারেরও বেশি কাদিয়ানী নিহত হয়। সেই সুযোগে আইয়ুব খান মার্শাল ল' জারি করেন। ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়। এই দলটি এখন যেভাবে খেলছে-আমার কাছে মনে হয়, সেই ইতিহাস পুনরাবৃত্তির জন্য এইসব খেলাধুলা করে থাকতে পারে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পথে হাটা বাধাগ্রস্ত করতে এই দলটি চেষ্টা করবে। কিন্তু এ বাধা আমাদের অতিক্রম করতে হবে।
টিবিএস: বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো শঙ্কা দেখছে বিএনপি?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: যা শুরু হয়েছে, তা শুধু বিএনপির জন্য নয়; গোটা জাতির জন্য শঙ্কার বিষয়। এটা সারা জাতির কাছে সংকটময় মুহূর্ত। আমি মনে করি, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই সংকট উত্তরণ সম্ভব। ৭১ আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়; রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে আমরা আমাদের পরিচয় ও মানচিত্র পেয়েছি। এখন সেই ইতিহাস ধোঁকা দিয়ে বিকৃত করার চেষ্টা হচ্ছে— পরাজিত শক্তি যুদ্ধ নিয়ে বিকৃত ইতিহাস তৈরির চেষ্টা করছে। সেটাকে বিনষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে। যুদ্ধ নিয়ে বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টি করছে পরাজিত শক্তি। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বলতে বলতে মুক্তিযুদ্ধকে হালকা করে দিয়েছে। ফলে পরাজিত শক্তি এই সুযোগ পেয়েছে। এর জন্য দায়ী শেখ হাসিনা। আমরা যারা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, তারা এটা গ্রহণ করতে পারছি না, হাসিনারটাও মানিনি।
টিবিএস: নির্বাচন আদায়ের জন্য রাজপথে আন্দোলনের প্রয়োজন আছে কি?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: আমি মনে করি আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। অধ্যাপক ইউনূস যখন নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়েছেন, তা ঘোষণার পর সারাদেশে নির্বাচনী গাড়ি চালু হয়ে গেছে; মানুষ এখন নির্বাচনের দিকে মুখিয়ে আছে। অবশ্যই কিছু ষড়যন্ত্র চলছে, কিন্তু এসব অতিক্রম করে অন্তর্বর্তী সরকার সুন্দরভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে বলে আমাদের আশা।
টিবিএস: প্রত্যেক সংসদীয় আসনে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রার্থী রয়েছে। চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ দেখছেন কি?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: রাজনীতি এক ধরণের স্পোর্টস; খেলায় অংশ নেয় ১০ জন, তবু প্রথম হয় একজন, দ্বিতীয় হয় একজন। অনেকে প্রার্থী হতে চায় কারণ আন্দোলনে সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে; অনেকেই জেল-জুলুম, হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। এখন আমাদের দেখতে হবে কে জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য; যে জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য, তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। সারাদেশে তারেক রহমানের লোকজন চষে বেড়াচ্ছে এবং নিয়মিত রিপোর্ট দিচ্ছে।
টিবিএস: ৫ আগস্টের পর জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: একাত্তরের যে চরিত্র ছিল, সেই চরিত্র আবার ফুটে উঠেছে।
টিবিএস: দুই যুগের বেশি সময় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট ছিল। জামায়াতের সঙ্গে জোট করা কি ভুল ছিল?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: ইলেকটোরিয়াল এলায়েন্স আর পলিটিক্যাল এলায়েন্স আলাদা। ভোটের সমীকরণে ইলেকটোরিয়াল এলায়ন্স হয়; পলিটিক্যাল এলায়ন্স হয় আদর্শের কারণে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির পলিটিক্যাল মিল ছিল না; তাই বিএনপি শুধুমাত্র ইলেকটোরিয়াল এলায়ন্স করেছিল। ভবিষ্যতে জামায়াতের সঙ্গে জোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না।
টিবিএস: এনসিপি সম্পর্কে কী বলবেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: আমি সাধারণত তাদের বিষয়ে মন্তব্য করি না। একসময় আমার বয়সও তাদের মতোই ছিল; ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম; অনেক ভাবনা-চিন্তা ছিল, বিপ্লব ঘুরছিলো। তাদেরও বয়স এমনই; তাই তাদের নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।
টিবিএস: আওয়ামী লীগের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: অবশ্যই আওয়ামী লীগের বিচার হবে। আওয়ামী লীগের শাসনে বিএনপিটি সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে, বহু মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বিএনপি স্বচ্ছভাবে বিচার করবে; বিচার অবধারিত, যে সরকার ই আসুক। যদি বিচার না করা হয়, জনগণ তা মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ যে অন্যায় করেছে, তা বিচার না করলে জনগণ ক্ষমা করবে না। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ফ্যাসিস্ট-খুনি; সেই বিচারের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে তারা রাজনীতি করতে পারবে কিনা।
টিবিএস: অনেকে বলে ক্ষমতায় গেলে বিএনপিও ফ্যাসিস্ট হবে। আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও কি ফ্যাসিস্ট হবে?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই নয়। আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি শক্তিশালী সাইকোলজিক্যাল প্রব্লেম আছে; তারা সাইকোলজিক্যালি ফ্যাসিস্ট পার্টি। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় গেছে, এই অন্যায়গুলো করছে। ১৯৭১–৭৫ এর শাসন আমরা দেখেছি; দশ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাই আমি বলি, আওয়ামী লীগের মধ্যে ফ্যাসিস্ট চরিত্র আছে। নিজেদের সেকুলার দল দাবি করে গত ১৬ বছরে তারা একই প্যাটার্ন চালিয়েছে এবং পশ্চিমা বিশ্বও তাদের সমর্থন দিয়েছে। বিএনপি কিন্তু তা নয়; বিপরীতে, বিএনপির ভুল-ত্রুটি থাকলেও তার মধ্যে এমন ক্যারেক্টার নেই। ২০০১ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন ফোন-ক্যামেরা বা সোশ্যাল মিডিয়া এত প্রচলিত ছিল না; এখন পৃথিবী অনেক উন্মুক্ত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোনো সরকারেরই দেশ চালানো সহজ হবে না; ফ্যাসিস্ট হওয়া তো দূরের কথা, সরকার চালাতেই কষ্ট হবে। যদি সিদ্ধান্ত জনগণের মনমত না হয়, মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের ঘটনা পরবর্তী অবস্থায় এই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
টিবিএস: আপনি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। আপনার সময়কাল নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে—এ বিষয়ে কী বলবেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ: আমরা আওয়ামী লীগের মতো ইনডেমনিটি আইন পাশ করে অন্যায়ভাবে কিছু করিনি। আমার সময়ের বিদ্যুৎখাতে যত নিন্দা হয়েছে, তা সত্ত্বেও গত ১৮ বছরে—১৬ বছর আওয়ামী লীগ ও ২ বছর কেয়ারটেকার মিলিয়ে; বিদ্যুৎ সংক্রান্ত কোনো মামলা হয়নি এবং দুদকও কিছু পায়নি। আমার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তা আমার ইনকাম ট্যাক্স ফাইল দেখে তোলা হয়েছে; এটাও প্রমাণ করে আমাদের আমলে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত দুর্নীতি হয়নি।
আওয়ামী লীগ ১৬ বছর ধরে 'খাম্বা-খাম্বা' করে অপপ্রচার করেছে, কিন্তু আজও তা নিয়ে কোনো মামলা দিতে পারেনি। খাম্বা ছিল এক প্রকল্পের অংশ; কেবল খাম্বাই কেনা হয়নি—ইনসুলেটর, ট্রান্সফরমার, তারও কেনা হয়েছে। এসব কথা বলা হচ্ছে না, শুধু খাম্বা খাম্বা আলোচিত হচ্ছে। খাম্বা বড় হওয়ায় রাস্তার পাশে পড়ে থাকে; এটাই চোখে পড়ে।ফেসবুকে আমি কোনো স্টেটমেন্ট করলে সো-কল্ড জামাতিরা লেখে 'খাম্বা'; আওয়ামী লীগ আগে থেকেই এসব করত। এখন জামায়াত-আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে লেখে। এতে আমাদের কিছু আসে-যায় না। ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস হলো—আমাদের আমলে এমন কোনো অন্যায় করিনি যার জন্য আমাদের দোষী করা যেতে পারে; আমরা আইন মেনে চলেছি।
আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটি দিয়ে যে কাজ করেছে, তার ফলস্বরূপ দেশে এখন ৫-৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র পড়ে আছে। এসব কেন্দ্র সীমিত গ্যাস সরবরাহের কারণে সচল হচ্ছে না; তবু জনগণকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। সরকার বদলালে এই অপচয়ের বোঝা নতুন সরকারের কাঁধে পড়বে। এই ইস্যু নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া উচিত।
