সংঘবদ্ধভাবে অতিমূল্যে মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি: ৩৪ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটের টিকিটের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর অভিযোগে সাতটি জেনারেল সেলস এজেন্ট এবং ২৭টি ট্রাভেল এজেন্সিকে প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে।
কমিশনের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়—যার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রবাসী শ্রমিক ও ওমরাহ যাত্রীরা।
৩৪টি অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সবগুলোর প্রতিনিধিদের আজ কমিশনের কার্যালয়ে শুনানিতে উপস্থিত হতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কেউ উপস্থিত না হলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার প্রক্রিয়া চলবে বলে কমিশন জানিয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধান: কৃত্রিম সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির প্রমাণ
কমিশনের দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি—যার সহকারী পরিচালক মো. আদনান আরিফ এবং উপপরিচালক দিনেশ সরকার—বিক্রয় রেকর্ড, বাজার তথ্য ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে, কয়েকটি জেনারেল সেলস এজেন্ট ও ট্রাভেল এজেন্সি "গ্রুপ বুকিং" নামে বিপুলসংখ্যক টিকিট আগাম ব্লক করে রেখেছিল এবং পরে সেগুলো প্রকৃত মূল্যের দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে বিক্রি করেছে।
তদন্তে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে জেদ্দা, রিয়াদ, মদিনা ও দাম্মাম রুটে টিকিটের দাম ওই তিন মাসে প্রতি টিকিটে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
যদিও সরাসরি কোনো এয়ারলাইনকে অভিযুক্ত করার প্রমাণ কমিশন পায়নি, তবে প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—বিক্রয় এজেন্টদের কর্মকাণ্ড "বাজারে কৃত্রিম সংকট" সৃষ্টি করেছে।
২০ অক্টোবরের নোটিশে কমিশন লিখেছে: "আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।"
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ
অভিযুক্ত জেনারেল সেলস এজেন্টদের মধ্যে রয়েছে: এয়ার গ্যালাক্সি লিমিটেড, ইউনাইটেড লিংক লিমিটেড, ওয়ান ওয়ার্ল্ড এভিয়েশন লিমিটেড, স্কাই এভিয়েশন সার্ভিসেস লিমিটেড, আই-বিজনেস হোল্ডিংস লিমিটেড, স্কাইজেট এভিয়েশন ও অ্যারোউইং এভিয়েশন লিমিটেড।
আর ২৭টি অভিযুক্ত ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে রয়েছে: কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এজেন্সি, কিং এয়ার এভিয়েশন, মেগা ইন্টারন্যাশনাল এয়ার সার্ভিস, মাদার লাভ এয়ার ট্রাভেলস, জেএস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস, ট্রাভেল চ্যাম্প লিমিটেড, ইলহাম ট্রাভেল কর্পোরেশন, হাজী এয়ার ট্রাভেলস লিমিটেড, গালফ ট্রাভেলস, আল-গাজি ট্রাভেলস ও ফ্লাই ফেয়ার ট্রাভেলস।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকারী তদন্ত কমিটিও একই ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করছে সেলস এজেন্টরা
এদিকে অভিযুক্ত জেনারেল সেলস এজেন্টরা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ, সাউদিয়া ও কাতার এয়ারওয়েজের একজন প্রতিনিধি এবং এয়ারলাইনস জিএসএ ফোরাম অব বাংলাদেশের আহ্বায়ক টিবিএসকে বলেন, "আমাদের বিরুদ্ধে টিকিটের দাম বাড়ানোর অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। জেনারেল সেলস এজেন্টদের (জিএসএ) টিকিটের দাম নির্ধারণের কোনো এখতিয়ার নেই। দাম ঠিক করে এয়ারলাইনস, আমরা শুধু তাদের নির্ধারিত রেটে বিক্রি করি।"
তিনি আরও জানান, জিএসএ ফোরাম আগেই সরকারের কাছে ২০ থেকে ৩০ পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাবনা জমা দিয়েছিল, যেখানে ভবিষ্যতে টিকিটের বাজারে কারসাজি ঠেকানোর উপায়গুলো উল্লেখ করা হয়।
হাজী এয়ার ট্রাভেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্মল চন্দ্র বৈরাগী বলেন, "আমি জানি না কেন আমাকে ডাকা হয়েছে। আমি কোনো গ্রুপ টিকিট বিক্রি করি না, ওমরাহ প্যাকেজও করি না—তাই এসব অভিযোগ আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবু যেহেতু ডাকা হয়েছে, তাই শুনানিতে গিয়ে আমার বক্তব্য দেব।"
বড় অংকের জরিমানা করতে পারে কমিশন
কমিশনের সদস্য মো. আদনান আরিফ জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানের ওপর শুনানি শেষে প্রয়োজনে কমিশন চাইলে নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে। তদন্ত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আবার শুনানি হবে। এরপর চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত হলে কমিশন দায়ীদের জরিমানা বা অন্যান্য নির্দেশনাবলী দিতে পারে। সাধারণত একটি কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করার এখতিয়ার রয়েছে কমিশনের।"
টিকিটের মূল্য কারসাজি নিয়ে প্রাথমিক তদন্তে যা জানা গেল
প্রতিযোগিতা কমিশনের নথি অনুযায়ী, ৪ মে ২০২৫ তারিখে সংস্থাটির এক সভায় ফ্লাইটের ভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়। উপস্থাপিত তথ্য ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় কমিশন সন্দেহ করে যে কিছু এয়ারলাইন ও তাদের বিক্রয় প্রতিনিধি মিলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।
এরপর কমিশনের তদন্তে দেখা যায়—সাউদিয়া, কাতার এয়ারওয়েজ, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার ও থাই এয়ারওয়েজ-এর মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনের স্থানীয় বিক্রয় এজেন্টরা বিপুলসংখ্যক টিকিট "গ্রুপ বুকিং" করে ব্লক করে রেখেছিল এবং পরে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে সেগুলো বিক্রি করেছে।
এ অবস্থায়, সরকারের হস্তক্ষেপের আগ পর্যন্ত—ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫—ঢাকা থেকে জেদ্দা, রিয়াদ, মদিনা ও দাম্মাম রুটে টিকিটের দাম ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। এতে ওমরাহ যাত্রী, প্রবাসী শ্রমিক, শিক্ষার্থী এবং প্রবাসী পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কী হতে পারে পরবর্তী পদক্ষেপ
কমিশনের সদস্য মো. আদনান আরিফ জানান, "প্রাথমিক তদন্ত ও শুনানির পর প্রয়োজনে নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত শেষে যদি চূড়ান্তভাবে দোষ প্রমাণিত হয়, তাহলে কমিশন জরিমানা বা অন্যান্য নির্দেশনা দিতে পারবে। কমিশনের আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা যায়।"
সরকারি পদক্ষেপে এখনও পূর্ণ স্বস্তি ফেরেনি
সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশনার পাশাপাশি উড়োজাহাজের জ্বালানি তেলের দাম কমলেও মধ্যপ্রাচ্যের রুটে টিকিট কারসাজি এখনো বন্ধ হয়নি।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এক সার্কুলারে নির্দেশ দেয়—সব টিকেট বুকিং এর ক্ষেত্রে এখন থেকে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও কপি সংযুক্ত থাকতে হবে; এবং তিন দিনের মধ্যে টিকিট ইস্যু না হলে বুকিং বাতিল করতে হবে। তবু অনেক বিদেশি এয়ারলাইন, বিশেষ করে বাজেট ও নন-আইএটিএ ক্যারিয়ারগুলো, এখনো এই নিয়ম মানছে না।
বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আটাব) জানায়, টিকিটের দাম কারসাজি সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। যদিও কোনো কোনো রুটে ভাড়া কিছুটা কমেছে, তবে জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, দুবাই ও দোহার মতো মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় রুটগুলোয় এখনো টিকিটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
বর্তমানে ঢাকা থেকে জেদ্দার ওয়ান-ওয়ে টিকিটের দাম প্রায় ৭০ হাজার টাকা, যেখানে বিপরীত রুটে অর্থাৎ জেদ্দা থেকে ঢাকার টিকেটের দাম মাত্র ২৫ হাজার টাকা।
ট্রাভেল এজেন্টরা বলছেন, টিকিটের 'বাল্ক কেনাবেচা' ও পুনর্বিক্রয় সংক্রান্ত নিয়ম যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে এখনই টিকেটের দাম আরও কমে যেত।
একজন ট্রাভেল এজেন্ট মাহমুদুল হক পেয়ারু বলেন, "কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও বড় গ্রুপ এখনো টিকিট মজুদ করে রেখে পরে বেশি দামে বিক্রি করছে। এটা বন্ধ না হলে দাম স্বাভাবিক হবে না।"
২১ আগস্টে মন্ত্রণালয় আবারও ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে—অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধি বা প্রতারণামূলক কার্যক্রমে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরে আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় আবারও স্পষ্ট করে জানায় যে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে জারিকৃত আগের নির্দেশনাগুলো এখনো কার্যকর রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যগামী রুটে টিকেটের দাম এখনো চড়া
মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ভাড়ার চাপ রয়েছে কাতার, রিয়াদ, জেদ্দা, দাম্মাম, মদিনা, দুবাই ও আবুধাবি রুটে।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো গন্তব্যে প্রতিযোগিতামূলক এয়ারলাইন কার্যক্রমের কারণে ভাড়া অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে।
