যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ ইসরায়েলপ্রীতি গাজায় শান্তি টিকতে দেবে না

গাজায় হত্যাযজ্ঞ আপাতত থেমে গেছে, এই খবরে স্বস্তি পাওয়াই স্বাভাবিক। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও, ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি ও ফিলিস্তিনি কয়েদিদের বিনিময় শুরু হয়েছে, ত্রাণ পৌঁছাতে পারছে বিপর্যস্ত গাজাবাসীর কাছে। প্রত্যাশিতভাবেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিকে "মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভোর" বলে ঘোষণা দিয়েছেন—যেন ইতিহাসের মোড় ঘুরে গেছে। এমন কথা তিনি আগেও বলেছেন, তাঁর আগের নেতারাও বলেছেন। আমিও চাই তিনি এবার সত্যি হোন, কিন্তু বাজি ধরতে পারি না।
এই যুদ্ধবিরতির পর দুটি প্রশ্ন বাতাসে ঝুলছে। প্রথমটি: এই শান্তি কি টিকবে? দ্বিতীয়টি—যার উত্তর প্রথমটির ভাগ্য নির্ধারণ করবে—ইসরায়েল ও বিশ্বের বাকিদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের, সম্পর্ক কি এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যা একদিন টেকসই শান্তির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আশাবাদী হওয়া কঠিন। সমালোচকেরা ঠিকই বলেছেন, এই "শান্তিচুক্তি" মূলত ইসরায়েলপন্থী মার্কিন মধ্যস্থতাকারী স্টিভ উইটকফ ও জ্যারেড কুশনারের তৈরি—যেখানে ফিলিস্তিনিদের অংশগ্রহণ ছিল ন্যূনতম। শেষ পর্যন্ত এটি সমঝোতা নয়, বরং একরকম আল্টিমেটাম।
ইসরায়েলের চরম দক্ষিণপন্থী অংশ যেমন গাজা সংযুক্তিকরণ বা ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বিতাড়নের দাবি তুলেছিল, তা এতে বাদ গেলেও ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপানো হয়েছে অবাস্তব ও অপ্রমাণযোগ্য শর্তাবলী—হামাসের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ, ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ ধ্বংস, তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের এক ধরনের "অস্পষ্ট" সংস্কার। এর ওপর নজরদারি করবে এক বহিরাগত "বোর্ড অব পিস", যার চেয়ারম্যান স্বয়ং ট্রাম্প।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই চুক্তিতে ইসরায়েলের পশ্চিম তীর দখল সম্প্রসারণের কথা একটিও নেই। রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের জন্য। পুরনো গল্পটা যেন ফিরে এসেছে—যেন ইসরায়েল উচ্ছ্বাসে ঘোষণা করতে পারে যে ফিলিস্তিনিরা শর্ত মানেনি, আর তখনই শুরু হবে তাদের নতুন দমননীতি বা হামলা।
সুতরাং গাজায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার কথিত এই পরিকল্পনা সফল হবে—এমনটা বিশ্বাস করতে হলে ধরতে হবে যে বাইরের বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের ওপর নিরবচ্ছিন্ন চাপ বজায় রাখবে যাতে তারা চুক্তি রক্ষা করে এবং অবশেষে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ন্যায্য সমাধানে পৌঁছায়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ট্রাম্প হয়তো এই মুহূর্তে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কালক্ষেপণ কৌশল নিয়ে বিরক্ত এবং তাকে সীমিত একটি চুক্তি করতে বাধ্য করেছেন—এটাই দেখায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট চাইলে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।
কিন্তু নেতানিয়াহু, তাঁর মিত্ররা বা ইসরায়েলি সমাজের মূলধারা—কেউই প্রকৃত দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বা ফিলিস্তিনিদের নিয়ে কোনো রকম এক রাষ্ট্রভিত্তিক কনফেডারেশনের জন্যও প্রস্তুত নয়। এমনকি যদি হামাস সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয়ও হয়ে যায়। আর ট্রাম্পের অস্থির মেজাজ, স্বল্প মনোযোগ, আর নীতি-অবহেলার ইতিহাস বিবেচনায় নিলে, কেউ কি বিশ্বাস করবে তিনি এই চুক্তিতে ধারাবাহিক মনোযোগ রাখতে পারবেন?
সমস্যা শুধু ট্রাম্পের নয়। বাইরের শক্তিগুলো প্রায়ই সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে—যেমন ১৯৫৬, ১৯৬৭ বা ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়—কিন্তু কখনোই পর্যাপ্ত সময়, মনোযোগ, বা রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করেনি যাতে একটি ন্যায্য ও টেকসই সমাধান আসে। ফলস্বরূপ, অসলো চুক্তি, ক্যাম্প ডেভিড, আনাপোলিস বা মধ্যপ্রাচ্য কোয়ার্টেট—সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক কি এখন এমনভাবে বদলাচ্ছে যা একে শান্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেই হোন না কেন?
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলা হামাসের জন্য যেমন বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তেমনি ইসরায়েলের গণহত্যামূলক প্রতিক্রিয়া তাদের নৈতিক অবস্থানকেও ধ্বংস করেছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে—যদিও তা প্রতীকী, কিন্তু বার্তাটি স্পষ্ট: বিশ্ব জনমতের দিক পাল্টে যাচ্ছে। ইসরায়েলের আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রচেষ্টা এখন স্থবির। যুক্তরাষ্ট্রে জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে—আরও বেশি আমেরিকান এখন ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল, এমনকি ৪১% মনে করে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড "গণহত্যা" বা তার কাছাকাছি কিছু।
ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন সবচেয়ে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে ডেমোক্র্যাট ও স্বতন্ত্র ভোটারদের মধ্যে, কিন্তু কট্টর রিপাবলিকানরাও (যেমন স্টিভ ব্যানন, টাকার কার্লসন, মারজোরি টেলর গ্রিন) এখন জায়নবাদের কঠোর সমালোচনায় নামছেন। ডেমোক্র্যাটরা মানবাধিকারভিত্তিক উদ্বেগে বলছেন, আর রক্ষণশীলদের কাছে "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির সঙ্গে ইসরায়েলকে এই অবিচল সমর্থন সাংঘর্ষিক বলে প্রতিভাত হচ্ছে।
এই "বিশেষ সম্পর্ক"-এর মূল্যও ছোট নয়। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ সামরিক সহায়তা গ্রহণকারী দেশ। বার্ষিক ৪ বিলিয়ন ডলারের এই সহায়তা গাজা যুদ্ধের সময় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ বিলিয়নে—যার সবটাই এসেছে মার্কিন করদাতার অর্থ থেকে। অথচ ইসরায়েল এখন ধনী দেশ, মাথাপিছু আয়ে বিশ্বে ১৬তম, আর তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারও বিশাল। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ জনগণ যুক্তরাষ্ট্রকে "মানবাধিকারের রক্ষক" নয়, বরং দ্বিমুখী পরাশক্তি হিসেবে দেখে। যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে—রাশিয়া বা চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে এটি এক উপহাসের বিষয়।
ইসরায়েল এমন একটি দেশ—যার জনসংখ্যা ১ কোটিরও কম— তবুও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে যে পরিমাণ সময় ও প্রভাব দখল করে আছে, তা অবিশ্বাস্য। ভাবুন, ভারত, জাপান, ইন্দোনেশিয়া বা নাইজেরিয়ার মতো বড় ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর তুলনায় ইসরায়েল কত বেশি সংবাদমাধ্যমে কাভারেজ পায়। ইসরায়েলের প্রায় সমান জনসংখ্যা ও জিডিপি অস্ট্রিয়ার, কিন্তু দেশটি নিয়ে কোনো শিরোনামই হয় না মার্কিন প্রচারমাধ্যমে।
ইসরায়েল-সংক্রান্ত বিতর্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া ও সংস্কৃতি জগতেও ছড়িয়ে পড়েছে। গাজায় গণহত্যা ও তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদকে "ইহুদিবিদ্বেষ" বলে দমন করা হচ্ছে। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন—সবকিছুই সংকুচিত হচ্ছে।
প্রেসিডেন্টদের সময়ও এর পেছনে নষ্ট হচ্ছে। জিমি কার্টার ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন, বিল ক্লিনটনও তাই করেছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন আফ্রিকা মহাদেশে চারবার গেলেও, ইসরায়েলে গেছেন ১৬ বার। প্রতিটি ঘণ্টা, যা এসব ইস্যুতে খরচ হচ্ছে, সেটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির প্রশ্ন থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে।
এই কারণেই আমরা অনেকে বারবার বলেছি—যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলের সঙ্গে "স্বাভাবিক সম্পর্ক" স্থাপন করা। অর্থাৎ, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হতে পারে, কিন্তু শর্তহীন নয়। যখন তাদের নীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে মিলে যাবে, তখন সহায়তা পাবে; আর যখন সেটির বিরোধিতা করবে—যেমন দখল সম্প্রসারণের মতো কাজে—তখন কড়া প্রতিবাদ ও চাপ আসা উচিত।
অনেকে বলবেন, ইসরায়েল "স্বাভাবিক দেশ" নয়—তার ইতিহাস, হলোকাস্টের উত্তরাধিকার, ও তীব্র আঞ্চলিক সংঘাতের কারণে। হয়তো তাই। কিন্তু ২০২৫ সালে, ঠিক এই "অস্বাভাবিকতাই" কারণ হওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন সমর্থন সীমিত করার।
ইসরায়েল এখন অনেকটাই "উন্মাদ রাষ্ট্র"—যেমন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ইয়েহেজকেল ড্রর বলেছিলেন—যে রাষ্ট্র: ১) আক্রমণাত্মক নীতি নেয়, ২) নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অন্ধ হয়, ৩) যুক্তিপূর্ণভাবে অনৈতিক উদ্দেশ্যও অনুসরণ করে, এবং ৪) তা করার ক্ষমতাও রাখে— সেই এই সংজ্ঞায় পড়ে। আর যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থনই ইসরায়েলকে আজ এই অবস্থায় এনেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অন্ধ সমর্থন ইসরায়েলের জন্যও বিপর্যয় ডেকে এনেছে। দেশটি ক্রমে ভেতর থেকে বিভক্ত হচ্ছে, মেসিয়ানিক দক্ষিণপন্থায় ভেসে যাচ্ছে, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তাই একটি "সদয় স্বাভাবিকতা"—যেখানে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হিসেবে রাখা হবে, কিন্তু নৈতিক দায়বদ্ধতার শর্ত দিয়ে— সেটাই হয়তো উভয়ের জন্যই উত্তম হবে।
কারণ, যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই স্থায়ী শান্তি চায়, তবে তার প্রথম কাজ হওয়া উচিত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কটিকে "স্বাভাবিক" করা—বিশেষ নয়, ন্যায্য করা।
লেখক: স্টিফেন এম. ওয়াল্ট, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়