বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যে করাচি বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব পাকিস্তানের; সামুদ্রিক সংযোগ বাড়ানোর আশা

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশকে করাচি বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তান। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য করাচি পোর্ট ট্রাস্ট (কেপিটি) পরিচালিত বন্দর ব্যবহার করলে একটি বিকল্প সমুদ্র রুট উন্মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক সংযোগ শক্তিশালী হবে বলে মনে করছে ইসলামাবাদ।
আগামী ২৭ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠকে প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। প্রায় দুই দশকের মধ্যে এটিই হবে দুই দেশের মধ্যে প্রথম জেইসি বৈঠক।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামুদ্রিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) ও পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশনের পিএনসিসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের বিষয়টিও পর্যালোচনা করা হবে এই সভায় ।
এ বিষয়ে অবগত কর্মকর্তারা বলেছেন, পাকিস্তানের এই প্রস্তাবটি আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। চীন থেকে পণ্য এনে করাচির মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো বা বাংলাদেশ থেকে চীনে পাঠানো আরও সহজ হতে পারে।
পাকিস্তান দুই দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিপিং কর্পোরেশনের মধ্যে একটি এমওইউ স্মারকের মাধ্যমে সহযোগিতাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে আগ্রহী। এই এমওইউ সই হলে দুই প্রতিষ্ঠান সরাসরি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে যুক্ত হতে পারবে। এতে সরাসরি জাহাজ চলাচল আরও সুসংহত ও নিয়মিত হবে এবং তৃতীয় দেশের বন্দরের ওপর নির্ভরতা কমবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
গত বছরের নভেম্বরে করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি প্রথম কার্গো জাহাজ এসে পৌঁছায়। এটি ছিল পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে দুই দেশের প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক যোগাযোগ।
এই ঘটনার পর পাকিস্তান সামুদ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে আগ্রহ প্রকাশ করে।
২০ বছর পর প্রথম জেইসি সভা
ইআরডির তথ্যমতে, প্রায় ২০ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান জেইসির নবম সভা। এর আগে দুই দেশের জেইসি সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল ২০০৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, ঢাকায়।
জেইসি সভা আয়োজনের লক্ষ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখের সভাপতিত্বে একটি প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আসন্ন জেইসি সভার এজেন্ডা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
জেইসি সভায় বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়ক ফেডারেল মন্ত্রী আহাদ খান চিমা পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়টি সভায় গুরুত্ব পাবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রপ্তানি ৬৬১ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশের থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি মাত্র ৫৭ মিলিয়ন ডলার ছিল।
কর্মকর্তারা বলেন, পাকিস্তারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে কোন কোন ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি করা সম্ভব, সেই বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। জেইসি সভায় সম্ভাবনাময় পণ্য নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানান তারা।
বর্তমানে পাকিস্তান থেকে মূলত তুলা ও সুতা, কাপড়, রাসায়নিক দ্রব্য, ওষুধ, লোহা ও ইস্পাত এবং প্লাস্টিকজাত সামগ্রী রপ্তানি করে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয় পাট ও পাটজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, সিরামিক, চামড়াজাত সামগ্রী ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য।
'দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের নতুন সুযোগ'
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, জাহাজ চলাচল ও বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের মধ্যে 'বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে'।
তিনি বলেন, 'প্রায় ১৫ বছরের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আসা দুই দেশের সম্পর্ক এখন অনুকূলে, যা বাণিজ্য বৃদ্ধির পথ সুগম করছে। পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি। যদিও বাংলাদেশও দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতি, তবুও পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি এখনও সীমিত।'
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের ঘরে হলেও বাংলাদেশের রপ্তানি নগণ্য। 'এই পরিস্থিতিতে করাচি বন্দরের সঙ্গে সরাসরি শিপিং লাইন চালু করা বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়াতে সহায়ক হবে। বিশেষভাবে তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার, লেদার ও ফুটওয়্যার, এগ্রো-প্রসেসিং পণ্য এবং আইটি ও ডিজিটাল সেবা পাকিস্তানের বাজারে সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে,' বলেন তিনি।
মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে ভিসা ও বিমান সংযোগ পুনরায় চালু হওয়ায় পর্যটন ও ব্যবসায়িক যোগাযোগও বাড়বে। এর ফলে দুই দেশের জনগণের এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, করাচি বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের সরাসরি রপ্তানি চালু করলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য বাজারে প্রবেশের সুযোগও তৈরি হবে। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচল চালু হলে খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে।
'পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার বড় অর্থনৈতিক বাজার হিসেবে বাংলাদেশের জন্য বাজার বহুমুখীকরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। করাচি বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি সম্প্রসারণের সঙ্গে ব্যবসা ও টুরিজমও সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে,' বলেন তিনি।
জেইসি বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন জেইসি সভায় বেশ কিছু নতুন সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাকিস্তান হালাল কর্তৃপক্ষ (পিএইচএ) ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে। আসন্ন জেইসি সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এগিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের চিনি শিল্প এগিয়ে নিতে যেতে পাকিস্তান কারিগরি সহযোগিতা প্রস্তাব দিয়েছে। এ বিষয়ে সভায় আলোচনা হবে।
এদিকে নিরাপত্তা সামগ্রী মুদ্রণে ব্যবহৃত কাগজ ও কালি আমদানিতে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত টেন্ডারে পাকিস্তানকে সুযোগ দেওয়ার বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হবে।
অন্যান্য আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে পাকিস্তানের আগ্রহ; উন্নত মানের গবাদি পশুর সিমেন আমদানির মাধ্যমে পশুর জাত উন্নয়নে সহযোগিতা এবং যৌথ উদ্যোগের আওতায় টিকা তৈরি, গবেষণা ও স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করা।
এছাড়াও বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য মডেল গ্রহণেও আগ্রহ দেখিয়েছে ইসলামাবাদ।
অন্যান্য আলোচ্যসূচির মধ্যে ডিজিটাল পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট ডিজিটালাইজেশনে সহায়তার প্রস্তাব, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০০ নতুন বৃত্তি প্রদানের প্রস্তাব এবং বাংলাদেশে একটি পাকিস্তানি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপনের প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সূত্র জানায়, যানবাহন ও দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান-সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়সহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়েও দুই দেশ সহযোগিতার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।